ব্রহ্মযামল তন্ত্র মতে, বাংলার অধিষ্ঠাত্রী হলেন দেবী কালিকা। বহু প্রাচীন কাল থেকেই বঙ্গদেশে কালীর সাধনা শুরু। একে একে গড়ে ওঠে বিখ্যাত কালী মন্দিরগুলি। কালী মানেই উগ্রচণ্ডা, ভয়ংকরী এমন একটা ধারণা আমাদের অনেকের মধ্যেই রয়েছে। সেক্ষেত্রে ব্যতিক্রম উত্তর ২৪ পরগনার অন্যতম প্রাচীন কালী মন্দির, আমডাঙা কালী মন্দির। এখানকার কালী মূর্তি শান্ত। ইতিহাসের আকর এই মন্দির। প্রায় সাড়ে চারশো বছরেরও বেশি প্রাচীন এই কালী মন্দিরে আজও মানুষ ভিড় জমান। মনস্কামনা পূরণ করেন মা, তাই দূর-দূরান্তের মানুষ নিত্য পুজো দেন। কালীপুজোয় সময় সবচেয়ে বেশি ভক্ত সমাগম হয়। সারা রাত ধরে পুজো চলে। সন্ধ্যায় দ্বিতল থেকে নামানোর আগে বারান্দায় মাকে বসিয়ে, মায়ের সামনে আঁখ, চাল কুমড়ো, কলা বলি দেওয়া হয়। তারপর মায়ের এস্টেট ঘুরিয়ে দেখানো হয়। তারপরই নিয়ে আসা হয় মাকে নাটমন্দিরে। সেখানেই রাত ভোর মায়ের পুজো চলে। এই মন্দিরের আরেকটি জনপ্রিয় উৎসব হল অন্নকূট উৎসব।
মা এখানে করুণাময়ী কালী। করুণাময়ী কালীমূর্তিটি মন্দিরের দোতলায় প্রতিষ্ঠিত। প্রায় দুই ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট মূর্তিটি কষ্টিপাথর নির্মিত। দেবীমূর্তি সালঙ্করা, ত্রিনয়না, মুণ্ডমালিনী ও মহাদেবের বক্ষের ওপর দন্ডায়মান। চন্দনকাঠের সূক্ষ কারুকার্যময় মন্দিরের প্রবেশদ্বার প্রায় ৪৫০ বছরের বেশি পুরনো। মন্দিরের একতলায় রত্নবেদীটি ১০৮টি শালগ্রাম শিলার উপর প্রতিষ্ঠিত।
মোঘল সাম্রাজ্যের উত্তরসূরী হিসেবে দিল্লীর সিংহাসনে বসলেন আকবর। ভারতব্যাপী এক বিশাল শক্তিশালী সাম্রাজ্য গড়ে তোলাই ছিল তার লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য পূরণে সম্রাট আকবর এক বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে যুবরাজ জাহাঙ্গীরকে ওপার বাংলায় অভিযানে পাঠান। কিন্তু যশোরের জমিদার বারোভুঁইয়াদের অন্যতম প্রতাপাদিত্য, মা যশোরেশ্বরীর কৃপায় মোঘল আক্রমণের মোকাবিলা করেন। সেই যুদ্ধে যুবরাজ জাহাঙ্গীর পরাজিত হলেন। এরপর সম্রাট আকবর অম্বররাজ সেনাপতি মানসিংহকে দ্বিতীয় বারের জন্য আক্রমণে পাঠালেন। কৌশলী সেনাপতি মানসিংহ তাঁর গুপ্তচর মারফত প্রতাপাদিত্য সম্পর্কে খোঁজ নিলেন। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন, প্রতাপাদিত্যের শক্তি ও পরাক্রমের উৎস হলেন শ্রীশ্রী মাতা যশোরেশ্বরী।
মানসিংহ এক ব্রাহ্মণের সাহায্যে ওই মন্দির থেকে যশোরেশ্বরী মাতার বিগ্রহকে সরিয়ে নিজ শিবিরে নিয়ে আসেন। এই খবর জানতে পেরে প্রতাপাদিত্য মন্দিরের প্রধান পুরোহিত রামানন্দগিরি গোস্বামীকে তিরস্কিৃত করলেন। শোকে কাতর পরম ধার্মিক ব্রাহ্মণ রামানন্দ দুঃখে উন্মাদ হয়ে যশোর ত্যাগ করলেন। অম্বররাজ ঠিক সেই সময় মোঘল বাহিনী নিয়ে প্রতাপাদিত্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন এবং তাঁকে পরাজিত ও বন্দী করে বাংলাদেশ দখল করলেন। অভিযান সফল হওয়ার পর অম্বররাজ মাতৃ বিগ্রহকে সন্মানের সাথে অম্বর প্রাসাদে অধিষ্ঠান করালেন। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে সেই 'যশোরেশ্বরী' মাতৃবিগ্রহ রাজস্থানের অম্বর ফোর্টে আজও অবস্থান করছেন।
অম্বর ফোর্টে মাতৃবিগ্রহ প্রতিষ্ঠা পরেই মহারাজ মানসিংহ দেবীর কাছে স্বপ্নাদেশ পান, তিনি যেন, দেবীর প্রধান পুরোহিত পরম ভক্ত রামানন্দগিরি গোস্বামীকে দিয়ে দেবীর বিকল্প করুণাময়ী মাতৃমূর্তি তৈরি করে প্রতিষ্ঠান করে আসেন। দেবীর আদেশে মানসিংহ বাংলাদেশে এসে রামানন্দগিরির খোঁজ করে যমুণা শাখা সূবর্ণাবতী, যার বর্তমান নাম সুঁটির খাল, সেই নদীর তীরবর্তী এলাকায় ব্রাহ্মণের দেখা পান। তখন তিনি যশোরেশ্বরীর বিকল্প করুণাময়ী মাতৃমূর্তি গড়ে প্রতিষ্ঠান করন। প্রাচীন সেই পুরোহিতের নাম ও নদীর তীরবর্তী স্থান অনুযায়ী এলাকার নাম হয় রামডাঙা। পরবর্তীতে কালক্রমে উচ্চারণ ভেদে সেই এলাকার নাম হয়েছে আমডাঙা। মন্দিরটি নাম হয়েছে, আমডাঙা করুনাময়ী মঠ। শোনা যায়, ১৫৬১ সালের দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধের পর আকবরের সেনাপতি মানসিং মা করুনাময়ীকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
এর প্রায় দুশো বছর পর ১৭৫৬ সালে ইংরেজদের বিতাড়িত করতে সিরাজদ্দৌলা কলকাতা আক্রমণ করেন। তখন নবাব বাহিনীর সাহায্য করে ছিলেন নদীয়াধিপতি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র। এখন যেখানে মন্দির, তার কাছেই কোন জায়গায় সে সময় নবাবের শিবির হয়েছিল। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র সেই শিবিরের পাশে ঘন জঙ্গলের মধ্যে মাতৃমূর্তি দেখতে পান। সেই সময় তিনি মাতৃমূর্তির সামনে বসে প্রার্থনা করেন, যদি মা তার মনোবাসনা পূর্ণ করেন, তা হলে তিনি মায়ের মন্দির ও পুজোর জন্যে যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহন করবেন।মনস্কামনা পূর্ণ হওয়ার পর তিনি এই মন্দিরে প্রায় ৩৬৫ বিঘা কর মুক্ত জমি দান করেন।
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজদ্দৌলা পরাজিত ও নিহত হওয়ার পর বাংলার মনসদে বসলেন মীরজাফর, তারপর তার জামাই মীরকাশিম সিংহাসনে বসেন। ১৭৬৪ সালে নবাব মীরকাশিম কৃষ্ণচন্দ্রকে মুঙ্গেরে বন্দী করে প্রাণদন্ডের আদেশ দেন। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের এই বিপদে আমডাঙা করুনাময়ী মঠের মোহান্ত পঞ্চমুন্ডির আসনে বসে করুনাময়ী মাতৃদেবীর আরাধনা করে দৈব শক্তির প্রভাবে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে বিপদ-মুক্ত করেন। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র মাতৃদেবীর এই অপার করুণায় কৃতজ্ঞ হয়ে আমডাঙা করুনাময়ী মঠ সংস্কারে ব্রতী হন। তারই সাহায্যে অধুনা যে দ্বিতল মন্দিরটি দেখা যায়, সেটি নির্মিত হয়েছিল। সেই থেকেই মন্দির জগৎ জোড়া খ্যাতি লাভ করে। এই মঠের প্রধান কে হবে সে সব নিয়ে অনেক আইনি লড়াই হয়েছে। মামলার জল কোর্ট কাছারি অবধি গড়িয়েছিল।
আমাদের আলোচ্য বিষয় কেবলই মন্দির। প্রতি বছর মায়ের বাৎসরিক উৎসব উপলক্ষ্যে ২৫ শে ও ২৬ শে ডিসেম্বর এখানে বৃহৎ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এখানকার বিশেষ দ্রষ্টব্য স্থান গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল 'রত্নবেদী'। ভারতের মধ্যে একমাত্র শ্রীক্ষেত্র ছাড়া আর কোন তীর্থক্ষেত্রে এই রত্নবেদী নেই। রত্নবেদীর মহাত্ম হল ১০৮ টি নারায়ণ শীলার উপর প্রতিষ্ঠিত এই আসন। শোনা যায় এই রত্নবেদীর আকর্ষনেই মহাসাধক রামপ্রসাদ ও পরমহংস ঠাকুর শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ এই মঠে এসেছিলেন। এখানকার দ্বিতীয় দ্রষ্টব্য স্থানটি হল 'পঞ্চমুন্ডী আসন'। তন্ত্র সাধকেরা এই আসনে বসে তন্ত্র সাধন করেন। মন্দিরের সেবায়েত, ব্রহ্মপরায়ন উপাধিকারী নারায়ণ গিরি এই আসনে বসেই সাধনার দ্বারা দৈববলে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে রক্ষা করেন। এখানে আরেকটি দেখবার মতো জিনিস হল মনসা বেদী বা বাস্তুতলা। স্থানীয়দের বিশ্বাস নিষ্ঠাভরে এই বেদীতে দুধ কলা সহযোগে পুজো দিলে সর্পদংশন ভয় দূ্র হয়। এছাড়াও ব্রজমোহন মন্দিরে রাধাকৃষ্ণের প্রেমময় যুগল মূর্তি রয়েছে।
কিংবদন্তি বলে, আমডাঙা কালী মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন মান সিংহ। মুঘল সম্রাট আকবরের সৈনদল দু-বার রাজা প্রতাপাদিত্যের কাছে পরাজিত হন। মোঘল সম্রাটের বিশ্বাস ছিল, যশোরের যশোরেশ্বরী মন্দিরে পুজো দিয়ে তার পর যুদ্ধ শুরু করতেন বলেই জয়লাভ করতেন প্রতাপাদিত্য। প্রতাপাদিত্যের এই রণকৌশল ভবিষ্যতে যাতে আর না হয়, সেই পরিকল্পনা করতে মান সিংহকে নিয়োগ করেন সম্রাট আকবর। মান সিংহ শুরুতেই যশোরেশ্বরী মন্দির থেকে বিগ্রহ সরিয়ে দেন। প্রতাপাদিত্য সে কথা জানতে পারার পরেই মন্দিরের পূজারী রামানন্দ গিরি গোস্বামীকে নির্বাসিত করে দণ্ড দেন। এর পর যুদ্ধে জয় লাভ করে রাজস্থানের অম্বরে সেই যশোরেশ্বরী মূর্তি স্থাপিন করেন মান সিংহ। অন্যদিকে নির্বাসিত হয়ে রামানন্দ এই আমডাঙ্গায় শুখাবতী বা সুটি নদীর ধারে জঙ্গলে এসে উপস্থিত হন। মান সিংহ স্বপ্নাদেশ পান, মায়ের শিষ্য রামানন্দ উন্মাদ অবস্থায় সুটি নদীর তীরে রয়েছেন। রামানন্দকে উন্মাদ অবস্থা থেকে শান্ত সাধক মার্গে ফিরিয়ে আনার জন্য কষ্টিপাথর দিয়ে কালীর শান্ত মূর্তি নির্মাণ করেন মান সিংহ। ১৫৬১ সালে বিগ্রহ তৈরি হওয়ার আমডাঙা কালী মন্দির যাত্রা শুরু হয়।
আমডাঙা মন্দিরে কালীর শান্ত মূর্তি পূজিত হয়। মন্দির ঘিরে পঞ্চদশ বা ১৫টি শিব মন্দির রয়েছে। মন্দিরের মহন্তরা মারা যাওয়ার পর তাঁদের সমাধিস্থল এর উপরে এই শিব মন্দিরগুলি গড়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক কালে মন্দির অত্যন্ত প্রাচীণ রীতির পরিবর্তন করা হয়েছে। বরাবরই এই মন্দিরে মা করুনাময়ীকে অমিষ ভোগ দেওয়া হত। কালী পুজোর রাতে বিশেষ ভাবে মায়ের জন্য নানা অমিষ পদ রান্না হত। মাছ ,মাংস ইত্যাদি থাকত। প্রতি বছর কালী পুজোর রাতে ভক্তরা তাদের মনস্কামনা পূরণের জন্য বলির জন্য ছাগল দান করতেন। এই মন্দিরে মা করুনাময়ী সারা বছর থাকেন মন্দিরে দ্বিতীয় তলে। কেবল কালী পুজো আর ২৫শে ডিসেম্বর মেলার দিন মা দ্বিতীয় তল থেকে নেমে আসেন। কালী পুজোর রাতে মায়ের সামনে একের পর এক ছাগল বলি দেওয়া হয়। তারকেশ্বর মন্দিরের মহন্তের নির্দেশ সেই রীতি বন্ধ করা হয়েছে। তারকেশ্বর মন্দিরের মহন্ত এই মন্দিরেরও মহন্ত। তাঁর নির্দেশেই মাকে আমিষ ভোগ দেওয়া ও বলি প্রথা বন্ধ হয়েছে। প্রায় সাড়ে চারশ বছরের ইতিহাস আগলে দাঁড়িয়ে আমডাঙা কালী মন্দির।