আজ কালী কথায় উত্তরের এক কালী মন্দিরের কথা, উত্তরবঙ্গের এক সদর শহর রায়গঞ্জ। দিনাজপুর ভাগে উত্তর দিনাজপুর হওয়ার পর থেকেই রায়গঞ্জ সদর শহর। কুলিক নদীর তীরে রায়গঞ্জ বন্দর অবস্থিত। ছোট তিন রাস্তার মোড়ে রয়েছে আদি করুনাময়ী কালী মন্দির। মন্দিরের আনুমানিক বয়স প্রায় ২০০ বছরের বেশি। এই মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে সাধক বামা ক্ষ্যাপার নাম। আজও সাধক বামাক্ষ্যাপার উত্তরসূরিরা এই মন্দিরের দায়িত্বে। কথিত রয়েছে, একদা কুলিক নদী দিয়ে বজরা নিয়ে বাণিজ্যে যেতেন সওদাগরেরা। এখন আর সে উপায় নেই, কুলিকের গতিপথ অনেকটাই ঋজু। তবে আজও রায়গঞ্জের বন্দরে কার্তিক অমাবস্যা তিথিতে পূজিতা হন মা।
আজও কালীপুজোর রাতে নাকি মন্দির থেকে মায়ের পায়ের নুপূরধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়। দেবীকে নাকি হেঁটে বেড়াতেও দেখেছেন অনেকে। এমন অজস্র গল্প ছড়িয়ে রয়েছে রায়গঞ্জ বন্দরের আদি কালীবাড়ির পুজো ঘিরে। প্রায় সাড়ে ৫০০ বছরের পুরোনো এই কালীপুজো। এটি উত্তর দিনাজপুর জেলার অন্যতম প্রাচীন ও জনপ্রিয় কালীপুজো। কালীপুজোর রাতে পার্শ্ববর্তী জেলা ও ভিন রাজ্য থেকেও বহু মানুষ ভিড় করেন রায়গঞ্জ বন্দরের আদি কালীবাড়িতে। কালীপুজোর রাতে কলকাতা সহ অন্যান্য জেলার পাশাপাশি ওডিশা, বিহার, এমনকি বাংলাদেশ থেকেও রায়গঞ্জ বন্দরের এই আদি কালীবাড়িতে প্রচুর ভক্ত আসেন। রায়গঞ্জ বন্দরের এই কালীবাড়ির পুজো ঠিক কত বছর আগে শুরু হয়েছিল, তা কারও জানা নেই। শোনা যায়, প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর আগে এই পুজোর প্রচলন হয়। সিদ্ধিলাভের জন্য পঞ্জাব প্রদেশের এক সাধু হেঁটে এসে কুলিক নদীর তীরে বন্দর এলাকায় একটি গাছের নীচে পঞ্চমুণ্ডি আসন প্রতিষ্ঠা করে সাধনায় বসেন। সিদ্ধিলাভও করেন তিনি। তারপর তিনি চলে যান। সেই থেকেই এই পঞ্চমুণ্ডির বেদিতে কালীপুজো শুরু হয়। তারপর নানা অলৌকিক ঘটনার পর এখানে মন্দির নির্মাণ হয়।
কথিত আছে, বেদি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখানে মা হেঁটে বেড়াতেন। রাতে মায়ের পায়ের নূপুরধ্বনি শোনা যেত। দিনাজপুরের রাজা মায়ের স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই স্থানে মন্দির নির্মাণ করেন। মন্দির নির্মাণের পর বামাক্ষ্যাপার উত্তরসূরী সাধক জানকীনাথ চট্টোপাধ্যায় ১২১৬ সালে বেনারস থেকে মায়ের কষ্টিপাথরের মূর্তি এনে মন্দিরে স্থাপন করেন। তখন থেকে এই মন্দিরে নিত্যপুজো শুরু হয়।
স্থানীয়দের বিশ্বাস আদি মন্দিরের মা কালী খুব জাগ্রত, তাঁর কাছে প্রার্থনা করলেই তা পূরণ হবে। প্রাচীনকালে বণিকেরা কুলিক নদী দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে যাওয়ার সময় এই মন্দিরে পুজো দিতে যেতেন। আগে কালীপুজোর রাতে মন্দিরের পাশের ঘাটে নৌকার ভিড় লেগে যেত।
তন্ত্রমতে দেবীর পুজো হয়। কালীপুজোর দিন শোল ও বোয়াল মাছ দিয়ে মাকে বিশেষ ভোগ দেওয়া হয়। রয়েছে পাঁঠাবলির রীতিও।
তবে এখানকার পুজো কবে শুরু হয়েছিল, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। একদল বলেন, সাধক বামাখ্যাপার বংশধরেরাই নাকি এই পুজো শুরু করেছিলেন। তাঁরাই বংশানুক্রমে আদি কালীমন্দিরের সেবাইত। প্রতিবছর দশহরা গঙ্গাপুজোর দিনে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষ্যে মায়ের পুজো হয়। কালীপুজোর দিন ছাড়াও বিশেষ বিশেষ দিনে এই মন্দিরে পুজো হয়। বলা হয়, ইংরেজির ১৮০৯ সাল এবং বাংলার ১২১৬ সনে উত্তর দিনাজপুরের মহারাজার আমলে সাধক জানকীনাথ চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে জৈষ্ঠ্যমাসের শুক্ল পক্ষে দশমী তিথিতে কষ্টি পাথরের মায়ের মূর্তি প্রতিষ্ঠা হয়।
আবার আরেক দলের বক্তব্য, ১২১৬ বঙ্গাব্দে দিনাজপুরের রাজা স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই স্থানে নির্মাণ করেন কালী মন্দির। এরপর তারাপীঠের মহাসাধক বামাখ্যাপার বংশধর জানকিনাথ চট্টোপাধ্যায় বারাণসী থেকে কষ্টিপাথরের কালীমূর্তি এনে পঞ্চমুণ্ডী আসনে প্রতিষ্ঠা করেন। সেই থেকেই ওই মূর্তির বন্দর আদি করুনাময়ী কালীবাড়িতে পূজিত হচ্ছে। কথিত আছে প্রায় পাঁচশো বছর আগে ১৪৭০ সালে পাঞ্জাব প্রদেশের এক সাধু পায়ে হেঁটে রায়গঞ্জের কুলিক নদীর বন্দর ঘাটে এসে হাজির হন। ঘাটের কাছেই এক বট গাছের তলায় পঞ্চমুন্ডীর আসন গড়ে ধ্যান করে সিদ্ধিলাভ করেন তিনি। সেই থেকে রায়গঞ্জে কালীর আরাধনার সূত্রপাত। সেখানেই আজকের মন্দির দাঁড়িয়ে রয়েছে। মন্দির প্রাঙ্গণে বট গাছটি আজও বিরাজমান। কষ্টিপাথরের মূর্তি আনুমানিক প্রায় ২০০ বছরের বেশি প্রাচীন। মন্দিরের ভেতরে পঞ্চমুন্ডির বেদির প্রতিষ্ঠাকাল প্রায় ৫০০ বছরেরও বেশি বলে অনুমান করা হয়।
এই মন্দির বহু ইতিহাসের সাক্ষী। সে সময় মায়ের কোনও মন্দির ছিল না। জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলে একদল ডাকাত ওই আসনে মায়ের পুজো করত। তারা ডাকাতি করতে যাওয়ার সময় ও ফিরে আসার পর দুই বার করে মায়ের পুজো দিয়ে যেত। পরে বাণিজ্য যাওয়ার সময় বা ফেরার সময় ধনী ব্যবসায়ীরাও এই বেদিতে পুজো দিয়ে যেতেন। এতে নাকি ডাকাতি হওয়ার কোনও ভয় থাকত না। পরে লোক মুখেই এই জায়গার মাহাত্ম্যের কথা ছড়িয়ে পড়ে। আবার কেউ কেউ বলেন, মায়ের ইচ্ছেতেই তৈরি হয় তাঁর মন্দির। আনুমানিক ১৮০৮ নাগাদ অবিভক্ত বাংলার দিনাজপুরের মহারাজা তারকনাথ চৌধুরি মায়ের স্বপ্নাদেশ পেয়ে এখানে একটি মন্দির গড়ে তোলেন। তিনিই সাধক বামাক্ষ্যাপার উত্তরসুরী জানকী নাথ চ্যাটার্জিকে এই মন্দিরে পুজোর দায়িত্ব দেন। ১৮০৯ সালে জানকী নাথবাবু বেনারস থেকে কষ্টি পাথরের বিগ্রহ এনে মাতৃ মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। যা এখনও এই মন্দিরে বিরাজমান।
তারও বহুকাল পর এই বন্দর ঘাটের পাশেই গড়ে ওঠে রায়গঞ্জ শহর। প্রাচীনকালে এই নদীবন্দর রাইগঞ্জ নামে পরিচিত ছিল। সেই প্রাচীন কাল থেকে পাঁচ পুরুষ ধরে বাম দেবের উত্তরসুরীরাই এই মন্দিরের প্রধান পুরোহিত। কালিপুজোর রাতে এখানে সপ্তসতী চন্ডীপাঠ ও হোম হয়। তন্ত্রমতে পুজো হয় বলে পশুবলী প্রথাও আছে। বহু প্রাচীন এই পুজো বর্তমানে সর্বজনীন কালিপুজোর রূপ নিয়েছে। স্থানীয়দের বিশ্বাস, এই মন্দিরের দেবী খুবই জাগ্রত।