আজ কালী কথায় মুক্তারাম বাবু স্ট্রিটের গল্প হবে। কলকাতায় দেশীয়দের নামে রাস্তার নামের অভাব নেই। সেকালের কলকাতায় হাতে গোনা যে ক'জন দেশীয়র নামে রাস্তা ছিল তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মুক্তারাম। আজকের কলকাতায় এই রাস্তা জমা জলের জন্যে খ্যাত। এখানেই রয়েছে মার্বেল প্যালস। এই মুক্তারামের তক্তারামে শুয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন শিবরাম চক্রবর্তী। এই মুক্তারাম বাবু স্ট্রিটেই রয়েছে অষ্টাদশভুজা গুহ্যকালী। শ্রী শ্রী আঠারো হাত কালী মন্দির, ঠিকানা ১৪০/এ মুক্তারাম বাবু স্ট্রিট। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ থেকে মুক্তারাম বাবু স্ট্রিট ধরে বিধান সরণির দিকে এগোতে ডান হাতে পড়বে মন্দির। মন্দিরের কথায় আসছি তার আগে অষ্টাদশভুজা কালী নিয়ে কিছু কথা হোক।
দেবী কালিকা হলেন মা দুর্গা বা পার্বতীর সংহারী রূপ। উনবিংশ শতকে লেখা শব্দকল্পদ্রুম বলছে 'কাল শিবহ্। তস্য পত্নতি কালী।' অর্থাৎ শিবই কাল বা কালবোধক। তাঁর পত্নী কালী। কালী হচ্ছেন মা দুর্গার বা পার্বতীর ভয়াল রূপ। তিনি সময়ের, পরিবর্তনের, শক্তির, সংহারের দেবী। তিনি কৃষ্ণবর্ণা বা মেঘবর্ণা। তিনি অশুভ শক্তির বিনাশকারিণী, শাক্ত সৃষ্টিতত্ত্ব মতে এবং শাক্ত-তান্ত্রিক বিশ্বাস মতে তিনিই পরম ব্রহ্ম। কালীকে এই সংহারী রূপের পরেও মা সম্বোধন করা হয়। তিনি মঙ্গলময়ী, তিনি কল্যাণী। কালীর অন্য নাম শ্যামা বা আদ্যাশক্তি। তন্ত্র অনুসারে, কালী দশমহাবিদ্যা নামে পরিচিত দশজন প্রধান তান্ত্রিক দেবীর প্রথম। দশমহাবিদ্যার ইনি প্রথমা মহাবিদ্যা। শাক্ত মতে, কালী বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আদি কারণ। দেবী কালীর অসংখ্য নামের মধ্যে দক্ষিণ, সিদ্ধ, গুহ্য, ভদ্র, শ্মশান, রক্ষা ও মহাকালী। মুক্তারাম বাবু স্ট্রিটের কালী হলেন গুহ্য কালী। শ্রী শ্রী চণ্ডীতে রয়েছে- 'ইয়া দেবী সর্বভতেষু চেতনেত্যাবিধীয়তে, নমস্তসৈ, নমস্তসৈ নমো নমোঃহ।' চণ্ডীতে দেবীর তিনটি চরিত্রের বর্ণনা আছে। দ্বিতীয় চরিত্রের কথা বলি।
মহিষাসুর ছিলেন দেবতাদের বলে বলিয়ান হওয়া পরাক্রমী অসুর। রম্ভাসুরের পুত্র এবং মহিষানী তার জননী। সেই মহিষাসুর দেবতার বরে পুরুষের অবধ্য ছিলেন। এক সময় সে দেবগনকে স্বর্গ ছাড়া করল। তারা পৃথিবীতে এসে ঘুরতে লাগল। এরপর দেবতারা একত্রিত হয়ে ব্রহ্মার কাছে গেলেন কিন্তু তার বরেই যে অসুর অপরাজেয় তাই দেবতারা তাকে নিয়ে বৈকুণ্ঠে গিয়ে দেখলেন শ্রীবিষ্ণু আর শিব কথা বলছেন। বিষ্ণু এবং শিবকে শুনলেন সব। সব শুনে বিষ্ণু এবং শিব ক্রোধিত হলেন, সঙ্গে ব্রহ্মা এবং দেবতারাও ক্রোধান্বিত হলেন, এসময় তাদের তেজ থেকেই সৃষ্টি হলেন জগৎজননী দেবী মহামায়া দুর্গা। শম্ভুর তেজে এই দেবীর মুখমণ্ডল, বিষ্ণুর তেজে বাহুযুগল ইত্যাদি এবং সমস্ত দেবতারা তাকে নানা অলঙ্কার এবং বিবিধ অস্ত্র দিয়ে সুসজ্জিত করলেন। তারপর তিনি অসুরকে বধ করতে গেলেন এবং বধ করলেন। মহিষাসুর বধে দেবী যে রূপে অবতীর্ন হয়েছিলেন তা হচ্ছে মহালক্ষী। ইনি অষ্টাদশভূজা অর্থাৎ আঠারো হাত এবং প্রসন্নবদনা। মুক্তারমের গুহ্য কালীও আঠারো ভূজ বিশিষ্টা। তবে আমরা মহিষসুরমর্দিনী রূপে দুর্গা পুজো করি, মৃন্ময়ী মূর্তিতে দেবীর দশ হাত থাকে। এখানে দেবীর আঠেরো হাত কারণ কালিকা পুরাণের ৬০তম অধ্যায়ে বর্নিত আছে- প্রথমকল্পে ভগবতী মহামায়া অষ্টদশভূজা উগ্রচন্ডারূপে মহিষাসুরকে বধ করেন। শিবের বর লাভ করে মহিষাসুর রম্ভাসুরে ঔরসে তিনবার জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং দেবী তিনবার বা তিন কল্পে তিন রূপে অসুর বধ করেন। দ্বিতীয় কল্পে ষোড়শভূজা ভদ্রকালীর রূপে অসুর বধ করেন। আর তৃতীয় অর্থাৎ শ্বেত বরাহকল্পে দেবী দশভূজা মহিষাসুরমর্দ্দিনী। তৃতীয় কল্পে অর্থাৎ শ্বেত বরাহকল্পে দেবী দশভূজা তাই দুর্গা পুজোয়, দেবী দশভূজা রূপেই পূজিতা হন।
এবার মুক্তারামের কথা। মুক্তারামবাবু স্ট্রিটেই অষ্টাদশভুজা গুহ্যকালীর নিবাস। রাস্তার ধারে মন্দির। গর্ভমন্দিরের অঙ্গন সামান্য প্রশস্ত। পাথরের বেদীর উপর কাঠের সিংহাসনে বিরাজ করে দেবী বিগ্রহ। দেবীর গাত্রবর্ণ কুচকুচে কালো, তেল চকচকে। আনুমানিক ১২০ বছর আগের কথা। তন্ত্রসাধক আশুতোষ মুখোপাধ্যায় গিয়েছিলেন নেপালে। ওখানে এক দুর্গম পাহাড়ের গুহায় তিনি পেয়েছিলেন একটি অষ্টাদশভুজা গুহ্যকালী বিগ্রহ। স্বপ্নাদেশ পেয়ে তিনি সেই বিগ্রহকে নিয়ে এলেন কলকাতায়। অনুরূপ একটি মূর্তি নির্মাণ করালেন সাধক। পাঁচ ফুট দৈর্ঘ্যের অষ্টধাতুর মূর্তির ওজন হল ১৮ মণ।দেবীর আদেশে বিগ্রহ নির্মাণ করেছিলেন দুজন শিল্পী। দুলাল ঠাকুর ও রাখাল ঠাকুর। জানা যায় বিগ্রহ নির্মাণের পর অতি অল্পদিনের মধ্যে তাঁরা মারা যান। কথিত আছে সেই মৃত্যুতেও নাকি দেবীর স্বপ্নাদেশ ছিল।
নেপাল থেকে আনা ছোট্ট বিগ্রহটি সযত্নে রয়েছেন। নিত্যপুজো পেয়ে আসছেন দেবী। দালান মন্দিরে গুহ্যকালী শায়িত শিবের উপর পদ্মাসনে বসে আছেন হাঁটু মুড়ে। গলায় মুণ্ডমালা। মাথায় রুপোর মুকুট। ত্রিনয়নী দেবী সবসনা। দেবীর আঠারো হাতে রয়েছে অভয়মুদ্রা, ঢাল, তলোয়ার, খড়্গ, কৃপাণ, শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম ইত্যাদি নানান রকমের আয়ুধ। অষ্টাদশভুজার ডানপাশে বেশ বড় আকারের সাদা মুখমণ্ডলটি মা শীতলার। বামদিকের রয়েছেন মা শীতলার পুত্র দেব জ্বরাসুরের।
এই মন্দিরে প্রতিদিন অন্নভোগ নিবেদন করা হয়। ভোর ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত মন্দির খোলা থাকে। আবার বিকাল ৪টেয় খোলা হয়, দেবীর শয়ন দিয়ে মন্দির বন্ধ হয় রাত ১০টায়। জৈষ্ঠ্য মাসের ফলহারিণী কালীপুজোর দিনটি অষ্টাদশভুজা গুহ্যকালীর প্রতিষ্ঠা দিবস হওয়ায় ওদিন মন্দিরে জাঁকজমকপূর্ণ উত্সব হয়। কালীপুজোর দিনও রীতি মেনে দেবীর পুজো হয়। আগে প্রতি কালীপুজোতেই এখানে মোষ বলি হত। পরে মন্দিরে রাধাকৃষ্ণ প্রতিষ্ঠার পর থেকে বলি প্রথা উঠে যায়। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ছেলে কালীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এই পশু বলি বন্ধ করেছিলেন। প্রতি বছর মায়ের পুজো হয় শাক্ত মতে। পুজো উপলক্ষ্যে অন্নকূট উত্সব আয়োজিত হয়। মন্দিরে তন্ত্রমতেও পুজো চলে। নেপালের দুর্গম পাহাড়ি গুহায় পাওয়া ১৮ হাত কালীমূর্তি আজও পূজিত হচ্ছে কলকাতায়।
কলকাতা কালীক্ষেত্র। কলকাতায় কালীর অভাব নেই। ফিরিঙ্গী কালী, কালীঘাটের কালী, ঠনঠনিয়ার সিদ্ধেশ্বরী কালীর মতো খাস কলকাতায় রয়েছে আঠারো হাত কালীবাড়ি যার ইতিহাস-ঐতিহ্য কোনও অংশ কম নয়। তবে মুক্তারামবাবু স্ট্রিটের স্বল্প পরিচিত গুহ্যকালী অনেকটাই আড়ালে থেকে যায়। আবার বীরভূমের আকালিপুরেও এক গুহ্যকালী মন্দির রয়েছে। কথিত আছে, মহারাজা নন্দকুমার স্বয়ং গুহ্যকালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সর্পের ওপর আসীন, সর্পের আবরণে ভূষিতা, বরাভয়দায়িনী, দ্বিভুজা জগন্মাতা গুহ্যকালী। ১১৭৮ বঙ্গাব্দের ১১ই মাঘ রটন্তী কালীপুজোর দিন এই মন্দির তৈরি হয়েছিল। প্রতিবছর মাঘ মাসে রটন্তী কালীপুজোর দিন বিশেষ পুজো করা হয়। দেবীর মূর্তিটি কালো পাথরের। দেবীর নিত্যপুজো চলে। দেবী অত্যন্ত জাগ্রত বলেই স্থানীয়দের বিশ্বাস।