উত্তর মোঙ্গোলিয়ার খেনতি পর্বতমালা। সেখান থেকে উৎপন্ন হওয়া এক নদী অনোন। আজ থেকে প্রায় সাড়ে আটশ বছর আগেকার কথা। এক ছোট্ট শিশু জন্ম নিয়েছিল এই নদীর তীরে ঘর বেঁধে থাকা এক পরিবারে। দরিদ্র পরিবারের কাছে সেই শিশু এক মুঠো আনন্দের মতো করেই এসেছিল। আদরে, স্নেহে বাবা মা ছেলের নাম রাখে তেমুজিন। কোন বিরাট স্বপ্ন দেখেনি সেই ছেলেকে নিয়ে তাঁরা। চেয়েছিলেন ছেলের সাহস যেন লোহার মত হয়। তেমনই নামের অর্থ ছিল লোহার মতো দৃঢ়। সার্থকনামা তেমুজিন লৌহকঠিন জীবন-যাপন করেছিলেন। জীবনের রোদের সঙ্গে যুদ্ধ করে বিশ্বজয় করেছিলেন এই তেমুজিন।
ছোট ছেলেটির শৈশব মোটেই সহজ ছিল না। বাবাকে হারাতে হয় অল্প বয়সেই। দুষ্কৃতিদের করা বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হয় তেমুজিনের বাবার। নিজেদের গোত্রের মধ্যেও লড়াই শুরু হয়। আপনজনেদের থেকে আঘাত পেয়েছিল তাদের পরিবার। তেমুজিনের মা হইলুন সন্তানকে নিয়ে একা লড়াই করেছিলেন। মায়ের বেঁচে থাকার সংগ্রাম সন্তানের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই এমন কঠিন পরিবেশে বড় হওয়ার ফলে শিশুমনে জমা হতে থাকে ঘৃণা আর বিদ্বেষ। শোনা যায় খাবার নিয়ে লড়াইয়ের ফলে এই তেমুজিন নাকি নিজের ভাইকেও হত্যা করেছিলেন। দীর্ঘ সময় তাকে ক্রীতদাস হিসেবে কাটাতে হয়। কিন্তু লড়াকু মানুষটি কিছুতেই দাসত্ব স্বীকার করতে রাজি হয়নি। পালিয়ে আসে সে।
নিজের মত নতুন দল তৈরি করে তেমুজিন। লড়াই, যুদ্ধ তখন তার আত্মার সঙ্গে মিশে গেছে। মাত্র কুড়ি বছর বয়সেই তার দক্ষতা তাকে নেতৃত্ব দিতে সাহায্য করে। তার অনুসারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। চিরবঞ্চিত এক যুবক স্বাদ পায় ক্ষমতার। বদলে যেতে থাকে লড়াইয়ের পরিসর। তেমুজিন স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। অন্যের আনুগত্য পাওয়ার তীব্র স্বপ্ন তাকে এগিয়ে দেয় আরও খানিকটা। ১২০৬ সাল নাগাদ বড়সড়ো এক সেনাবাহিনীতে যোগদান করে সে। আস্তে আস্তে হারিয়ে যায় তেমুজিন। নতুন এক যোদ্ধার জন্ম হয়। বিশ্ব এই যোদ্ধাকে চেনে ‘চেঙ্গিস খান’ নামে। ঐতিহাসিকরা বলেন চেঙ্গিস খান নামের মানে হল ‘বিশ্বজনীন শাসক’।
এরপর চেঙ্গিস খান শুরু করেন তাঁর বিশ্বজয়ের অভিযান। একের পর এক রাজ্য শক্তিশালী মঙ্গোলবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে থাকে। যে রাজ্যে মেঙ্গলদের ছায়া পড়ত, সেই রাজ্যে অন্ধকার নেমে আসত। চেঙ্গিস খান নিজের বুদ্ধির জোরে পরাস্ত করতেন অন্য যোদ্ধাদের।
১২২৭ সালে হঠাৎ করেই মৃত্যু হয় চেঙ্গিস খানের, কিন্তু ততদিনে চেঙ্গিস খানের নাম ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। যোদ্ধা হিসেবে তিনি হয়ে উঠেছেন সকলের ত্রাস। তাঁর প্রতিষ্ঠিত মোঙ্গল সাম্রাজ্য পৃথিবীর কাছে দুঃস্বপ্নের নামান্তর হিসেবে পরিচিত হতে থাকে।
চেঙ্গিস খানের জীবনে আশ্চর্যরকম ভাবে তার পাশে দাঁড়ায় প্রকৃতি। যুদ্ধের ইতিহাস বলে অনেক ক্ষেত্রেই অনেক যুদ্ধের পরিসমাপ্তি বদলে গেছে শুধুমাত্র আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে। যুদ্ধের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রেই সৈন্যসংখ্যা, অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ এসব দিকে এগিয়ে থাকলেও খারাপ আবহাওয়ার কারণে অনেকে হেরে গেছেন। যেমন নেপোলিয়নের নেতৃত্বাধীন ফরাসি বাহিনী রাশিয়ায় আক্রমণ চালিয়ে হেরে যায়, এর মূল কারণ হিসেবে বলা হয় রাশিয়ার কনকনে ঠান্ডা আবহাওয়া। নেপোলিয়নের বাহিনী তখন গ্রীষ্মকালের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তাদের কাছে ছিল না কোন গরম জামা। নেপোলিয়ন ভেবেছিলেন রাশিয়াকে কুড়িদিনের মধ্যেই হারানো সম্ভব। তাই মোটামুটি এক মাসের রসদ নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এই যুদ্ধ স্থায়ী হয়েছিল সাড়ে পাঁচ মাস। ততদিনে শীত আর খাদ্যসংকট কাবু করে ফেলেছে নেপোলিয়নকে।
চেঙ্গিস খানের সঙ্গে ও এমনটা ঘটেছিল। তবে এই বিষয়টি উঠে এসেছে সাম্প্রতিক গবেষণায়। কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি ল্যামন্ট-ডোহার্টি আর্থ অবজারভেটরি এবং ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া ইউনিভারসিটির একদল গবেষক কয়েকটি গাছের ট্রি-রিং গবেষণা করেছেন। মূলত সেই সময়ের পাইন গাছের ট্রি-রিং-এর জীবাশ্ম গবেষণা করে দেখেছেন মোঙ্গোলিয়ার শুষ্ক, অনুর্বর ঠান্ডা অঞ্চলে চেঙ্গিস খানের উত্থানকালীন সময়ে একনাগাড়ে ১৫ বছর ধরে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছিল। এই বিষয়ে একটি গবেষণা পত্র প্রকাশ করেছিলেন তাঁরা।
১২১১ থেকে ১২২৫ সাল, মূলত এই সময়কালের গাছের ট্রি রিং নিয়ে গবেষণা করেছিলেন গবেষকরা। এই সময়টা ছিল মোঙ্গল সাম্রাজ্যের উন্নতির সময়। এই সময়ে মোঙ্গলিয়ায় প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছিল। ফলে আবহাওয়ার অনেক পরিবর্তন আসে। চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার বদলে মোঙ্গোলিয়ার অধিবাসীরা অন্য আবহাওয়ায় নিজেদেরকে আবিষ্কার করে। এই আবহাওয়া তাদের জীবনযাত্রাকে সহজ করে দিয়েছিল। যুদ্ধ জেতার পক্ষে এই আবহাওয়া তাদের জন্য অনুকূল আবহাওয়া হিসেবে পরিচিত হয়। পর্যাপ্ত বৃষ্টির পরিমাণের ফলে মোঙ্গোলিয়ায় প্রচুর ঘাস জন্মাতে শুরু করে। সবুজের সমারোহ দেখা যাওয়া শুরু হয়েছিল সেই সময়। ফলে তৃণভোজী প্রাণীরা লাভবান হয়। এই প্রাণীদের মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যে উন্নতি ঘটেছিল মঙ্গোলিয়ায়। মোঙ্গল সাম্রাজ্যের অনেক যুদ্ধ জেতার পেছনে কারণ ছিল তাদের ঘোড়া। ঘোড়াগুলো চেঙ্গিস খান কে যুদ্ধ জিততে অনেকটা সাহায্য করেছিল। একটা রাজ্যের ব্যবসা-বাণিজ্য সুপথে যাচ্ছে, ফলে সেই রাজ্যের অর্থনীতি, সমাজনীতি বেশ সুন্দরভাবে পরিচালিত হচ্ছে।
তৃণভোজী হওয়ার কারণে ঘোড়াদের স্বাস্থ্য ভাল হয়ে গিয়েছিল সেই সময়। তাই এই রাজ্যের পক্ষে যুদ্ধ জয় করা খুব বিশেষ কঠিন হয়নি। এমনকি ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো হওয়ার ফলে রাজ্যের মধ্যে ছিল না কোন বিরোধ। আজ এই সব মিলিয়েই চেঙ্গিস খানের উত্থান সেই সময় কেউ আটকাতে পারেনি। পরে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন দীর্ঘ বছর ধরে মোঙ্গলিয়ায় এমন আবহাওয়া পাওয়া যায়নি। মেঙ্গোলিয়ার আবহাওয়ার কারণে খাদ্য সংকট তাদের সবসময়ের সঙ্গী ছিল। ফলে রাজ্যে হানাহানি ও বিরোধ লেগেই থাকত। কিন্তু চেঙ্গিস খানের ওই উত্থানের সময়টুকুতে সবটাই অন্যরকম ছিল। গবেষকরা বলেন এর মূল কারণ সেই সময় প্রকৃতির হঠাৎ বদলে যাওয়া। হঠাৎ বদলে গিয়ে প্রকৃতি যেন চেঙ্গিস খান আর তার উত্থানকে স্নেহের ছায়ায় আগলে রেখেছিল। যদিও খুব অল্প বয়সেই মারা যায় চেঙ্গিস খান, তবুও প্রকৃতির উদারতায় আর নিজের বুদ্ধির জোরে চেঙ্গিস খান ইতিহাসের পাতায় এক অমর নাম হিসেবে রয়ে গেছে।