কালী কথা: ডাকাতদের হাতে প্রতিষ্ঠিত বনগাঁর সাত ভাই কালী মন্দির

বাংলায় ডাকাত আর দেবী কালিকা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছে। অন্তত দুশো কালী মন্দির রয়েছে বাংলায়; যে মন্দিরগুলোর সঙ্গে মিশে রয়েছে ভয়ঙ্কর ডাকাতদের কাহিনি-কিংবদন্তি। বেশ কিছু মন্দির প্রতিষ্ঠাই হয়েছিল ডাকাতদের হাতে। তেমনই উত্তর ২৪ পরগণার সীমান্ত শহর বনগাঁয় রয়েছে সাত ভাই কালী মন্দির। ডাকাতদের হাতেই এই মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। কেউ কেউ বলেন, এই মন্দিরের বয়স প্রায় চারশো বছর। শোনা যায়, ডাকাতি করে ফেরার সময় ডাকাতদের উদ্দেশ্যে স্বয়ং কালীঠাকুর নাকি বলেছিলেন, ''তোরা সব কিছু নিয়ে যাচ্ছিস, আমাকে নিবি না? তোরা আমার সবই যখন নিয়ে যাচ্ছিস, তখন আমাকেও নিয়ে চল।" এই শুনে ডাকাত দল কালীঠাকুরকে সঙ্গে করে নিয়ে আসে। প্রায় ৩০০ কিলোমিটার নদীপথ পাড়ি দিয়ে বনগাঁর ইছামতি নদীর ধারে এসে হাজির হয় ডাকাত দল। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া বনগাঁ থানার কালুপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের পুরাতন বনগাঁর ইছামতী নদীতীরে ডাকাতের দল দেবী কালিকাকে নিয়ে আসে। বন, জঙ্গলে ঘেরা বট গাছের নীচে প্রতিষ্ঠা করা হয় কালীমূর্তি। সেই থেকে চলে আসছে বনগাঁর সাত ভাই কালীতলার পুজো। ডাকাতদের আস্তানা বনগাঁ।

IMG-20230915-WA0001

গাছের নীচে কালী মায়ের মূর্তি রেখে পুজোর জন্য পুরোহিত খুঁজতে বের হয় ডাকাত দল। স্থানীয় এক চক্রবর্তী ব্রাহ্মণ পুরোহিতকে খুঁজে বের করে। তিনিই মায়ের পুজো শুরু করেন। প্রায় ৪০০ বছর আগের এই ঘটনা। সেই থেকে আজও মা কালী পুজো পেয়ে আসছেন। মায়ের পুজো বংশ পরম্পরায় করে আসছেন চক্রবর্তীরা৷ চক্রবর্তীর পরিবারের হাতে পুজোর দায়িত্ব দিয়েছিল ডাকাতরাই। চক্রবর্তী বংশের সাত পুরোহিত পালা করে নিত্যপুজো করেন। তবে মন্দিরের প্রাচীন মূর্তিটি বটগাছের শিকড়ে ঢেকে গিয়েছে। এখনকার পূজিত মূর্তিটি পরে তৈরি হয়েছে।কালীপুজোর দিন মন্দিরে বিশেষ পুজোর আয়োজন হয়। ভক্তরা বলেন, মন্দিরটি খুবই জাগ্রত। দেবী মনোবাসনা পূরণ করেন। প্রতিদিন দু-বেলা নিত্য পুজো হয় এখানে। গোটা বছর জুড়েই বিপুল ভক্ত সমাগম হয়।

বনগাঁর এই কালী মন্দির সাত ভাই কালী মন্দির নামে পরিচিত, লোকমুখে এলাকার নাম হয়ে গিয়েছে সাত ভাই কালীতলা। আদপে সাত ভাই থেকেই এমন নামের জন্ম, ডাকাতরা সাত জন ছিল একে অপরের ভাই। কথিত আছে, অবিভক্ত বাংলার যশোরের জমিদার বাড়িতে ডাকাতি করতে গিয়েছিল সাত জন ডাকাতের একটি দল। কালীচরণ, কালীপ্রসাদ, কালীকিংকর, কালীপ্রসন্ন-সহ মোট সাত জন, সম্পর্কে তারা ছিল আপন ভাই। ডাকাতি করে ফেরার পথে তারা কালী মূর্তির দেখা পায়। জমিদারবাড়ির সমস্ত কিছু নেওয়ার পর মন্দিরের বাসন সামগ্রীও ডাকাতি করে তারা। ডাকাতির পরে জমিদার বাড়ির মন্দিরের জাগ্রত মা ডাকাতদের উদ্দেশ্যে আদেশ দেয়। ওই ডাকাতদল দেবী কালিকার আদেশেই কালী মূর্তিও সঙ্গে করে নিয়ে আসে। দেবীর নির্দেশ মতোই শ্মশানের পাশে ইছামতীর পাড়ে বটগাছের তলায় কালী মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে৷ মন্দির গড়ে ওঠে বনগাঁয়, সেই কালী মন্দিরই সাত ভাই কালীতলা নামে পরিচিত। মন্দিরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বাজার, কমিউনিটি হল ও স্কুল।

সীমান্ত শহর বনগাঁ দিয়ে বয়ে গিয়েছে ইছামতী নদী, সবুজের সম্ভার৷ ওই নদী লাগোয়াই অবস্থিত বনগাঁর সাতভাই কালীতলা৷ তিনশো বছর পেরিয়ে আজও এই মন্দিরে পূজিতা হচ্ছেন মা। কোনও এক পৌষ মাসের রাতে মা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। সেই থেকে আজও প্রতি বছর পৌষ মাসের শনি ও মঙ্গলবার সাত ভাই কালীতলায় বিশেষ পুজো হয়৷ বছরের ওই সময় দূরদূরান্তের বহু মানুষ ভিড় জমান সাতভাই কালীতলায়৷ ইছামতী নদী পেরিয়ে নৌকা করেও মায়ের কাছে আসেন বহু ভক্ত৷ বট গাছে লাল-নীল সুতোয় ঢেলা বেঁধে মানত করেন ভক্তেরা৷ মনোবাসনা পূর্ণ হলেই পুজো দিয়ে ওই গিঁট খুলে দিয়ে যান তাঁরা৷ পৌষ মাসে একেবারে উৎসব আমেজ উপলব্ধি করা যায় মন্দির এলাকায়৷ মেলাও বসে৷ পৌষ মাস জুড়ে কালী মন্দির চত্বরে মেলা বসে। প্রতিবছর মন্দিরের মাঠে খিচুড়ি রান্না করে ভক্তদের বিতরণ করা হয়। মন্দিরের পিছনে একটা বড় মাঠ রয়েছে। বাঁদিকে উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল ও আরেক দিকে প্রাইমারী স্কুল; দুটি স্কুলের মাঝে সারা মাঠজুড়ে মেলা বসে। মাঠের শেষে বয়ে চলে ইছামতী নদী। কার্তিক মাসেও বহু মানুষ এখানে আসেন।

  • ট্যাগ

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...