বাসন্তী পুজোর ইতিকথা

যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমো। মন্ত্র উচ্চারণ শুনলেই মনে হয় শরতের নীল আকাশ, সাদা মেঘ ভাসছে, ছাতিমের গন্ধে ভরপুর বাতাস, শ্বেতশুভ্র কাশফুলের মাথা দোলানোর কথা মনে পরে। তবে শিমূল-পলাশের রাজত্বের দিনেও; যদি এক মন্ত্রোচ্চারিত হয়, সেই কাশজড়িত ঢাকের বাদ্যি যদি বসন্ত দিনের সকাল সকাল বেজে ওঠে, কেমন হয় বলুন তো?

বসন্তের মধ্যেও শরতের আমেজ! আর এই আমেজ একমাত্র আনতে পারে আদি দূর্গাপুজো। জানেন কি কী এই 'আদি দূর্গাপুজো'?

এই আদি দুর্গাপুজোই হল বাসন্তী পুজো। স্মরণাতীত কাল থেকে এই পুজো ভারত ভূখণ্ডে হয়ে আসছে। কিন্তু কালে কালে শারদীয়ার বাড়বাড়ন্তে, বসন্তিকার আধারণা অনেকটাই ম্লান। যা বর্তমান সময়ে দক্ষিণবঙ্গ ও উত্তরবঙ্গ মিলিয়ে গুটিকয়েক পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়ে গিয়েছে।​

ইতিহাস বলছে, চৈত্রমাসের শুক্লপক্ষের বাসন্তী পুজোই প্রকৃতপক্ষে দুর্গাপুজো। যদিও পরবর্তী কালে আশ্বিন শুক্লপক্ষের দুর্গাপুজোই অন্যতম প্রধান পুজোর স্বীকৃতি পায়। অশুভ শক্তির বিনাশের জন্য মানুষ আদ্যাশক্তির আরাধনা করেন। পুরাণ অনুযায়ী, রাজা সুরথ সুশাসক ও পরাক্রমী যোদ্ধা হিসেবে বেশ খ্যাত ছিলেন। কোনও যুদ্ধে নাকি তিনি কখনও হারেননি। কিন্তু প্রতিবেশী রাজ্যের রাজা একদিন তাঁকে আক্রমণ করে এবং সুরথ পরাজিত হন। এই সুযোগে তাঁর সভাসদরাও লুটপাট চালায়। কাছের মানুষের এমন আচরণে স্তম্ভিত হয়ে যান সুরথ। বনে ঘুরতে ঘুরতে তিনি মেধাসাশ্রমে পৌঁছোন।

ঋষি তাঁকে সেখানেই থাকতে বলেন। কিন্তু রাজা শান্তি পান না। এর মধ্যে একদিন তাঁর সমাধির সঙ্গে দেখা হয়। তিনি জানতে পারেন, সমাধিকেও তাঁর স্ত্রী এবং ছেলে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। তবুও তিনি স্ত্রী পুত্রের ভালোমন্দ এখনও ভেবে চলেছেন।

তাঁরা দুজনেই তখন ভাবলেন, যাদের কারণে তাদের সব কিছু হারিয়েছে, তাদের ভালো আজও তারা চেয়ে যাচ্ছেন। ঋষিকে একথা বলায়, তিনি বলেন সবই মহামায়ার ইচ্ছা। এরপর ঋষি মহামায়ার কাহিনি বর্ণনা করেন। ঋষির উপদেশেই রাজা কঠিন তপস্যা শুরু করেন। সমাধি নামক বৈশ্যের সঙ্গে মিলে রাজ্য হারানো রাজা সুরথ বসন্তকালে ঋষি মেধসের আশ্রমে মূর্তি গড়ে দেবী দুর্গার আরাধনা করেন। যা পরে বাসন্তী পুজো নামে পরিচিতি পায় এবং সেটাই চলতে থাকে। পরে মহামায়ার আশীর্বাদ পেতেই বসন্ত কালের শুক্ল পক্ষে রাজা পুজো শুরু করেন, এইভাবেই শুরু হয় বাসন্তী পুজো।

আবার রামচন্দ্র সীতাকে রাবণের অধীন থেকে উদ্ধার কালে অশুভ শক্তির বিনাশের জন্য শরৎকালে রামচন্দ্র দুর্গার আরাধনা করছিলেন। তার পর থেকে পুজোই চলতে থাকল। পুজোর সময় ছিল সূর্যের দক্ষিণায়ন এবং দেবতাদের নিদ্রার সময়। দেবতাদের নিদ্রার সময় বলেই, এই সময় বোধন করা হয়। দক্ষিণায়নের সময় দেবীর ঘুম ভাঙানো হল বলে, শারদীয়া অকালবোধন হিসেবে খ্যাতি পেল।

পুরাণে দুটি কালে বছরকে ভাগ করা হয়েছে, উত্তরায়ণ এবং দক্ষিণায়ণ। পুরাণ অনুযায়ী উত্তরায়ণে অর্থাৎ সূর্য যে সময় পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের কাছাকাছি থাকে; সেই সময় দেবদেবীরা জেগেই থাকন। আর দক্ষিণায়ণের অর্থাৎ সূর্য যে সময় পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধের কাছাকাছি থাকে, তখন হল তাঁদের নিদ্রার সময়। দক্ষিণায়ণের এই ছ-মাস হল- শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ ও পৌষ। এ সময় তাঁরা ঘুমিয়ে থাকেন। তাই তাঁদের জাগানোর জন্য বোধনের প্রয়োজন হয়। তাই একটা দীর্ঘ সময় কোনও পুজো অর্চণার সুযোগ ছিল না। রাজা সুরথ এই সময় পুরোহিতদের ডেকে বলেন, পাঁজি পুঁথি ঘেঁটে এ সময়ে কোনও পুজা করা যায় কিনা তা দেখতে। সে সময় এক পুরোহিত তাঁকে বলেন, রামচন্দ্রের অকাল বোধনের কথা। সেই থেকে পুজোর চল বলে অনেকে মনে করেন।

বছরের এমন সময় বাসন্তী পুজো প্রচলিত হওয়ার, নেপথ্যে অন্য একটি কারণও রয়েছে বলে, কেউ কেউ মনে করেন। বসন্ত ঋতুর শেষে গ্রীষ্মের শুরুর, এই সময়টাতে সেকালে বসন্ত রোগের প্রকোপ খুব বেশি ছিল। টিকাহীন চিকিৎসাহীন সেই অতীতে দুর্বার বসন্তের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য মায়ের আরাধনা করে, মায়ের কৃপা প্রার্থনা করা হত। হয়ত রোগকে প্রশমিত করার জন্য তাই বাসন্তীদেবীর পুজোর প্রচলন হয়েছিল। 

বাল্মীকি তাঁর রচনায় অকালবোধনের ঘটনাটি উল্লেখ করেছিলেন ঠিকই। কিন্তু কবি কৃত্তিবাস ওঝা তাঁর রামায়ণে এই অংশের এমন আবেগতাড়িত বর্ণনা দেন যে, তা বরাবরের জন্য বাঙালির চিত্তে গেঁথে যায়। শরৎকালের দুর্গাপুজো এইভাবেই ধীরে ধীরে তার নিজস্ব ধর্মীয়-সামাজিক-সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞান রচনা করে গণমনে চিরস্থায়ী হয়ে ওঠে। 

একটা জাতির পুজোর ইতিহাসটাকেই হুবহু বদলে গেল! বাঙালির দুর্গাপুজোর দিনক্ষণ এভাবে আমূল বদলে গেল, অন্য দিকে কোনও ঢাকের বাদ্যি নেই, নেই কোনও মন্ত্রোচ্চারণ। সেজে ওঠা মণ্ডপ নেই। কিন্তু চুপিসাড়ে আরও একটি দুর্গাপুজো দিনক্ষণ মেনে ঘটে চলছে, তা বোধহয় কেউ লক্ষ্য করছেন না।

দুর্গা পূজা এবং বাঙালি এই দুটি শব্দ সমার্থক, একটির সঙ্গে অন্যটি জড়িয়ে রয়েছে। দুর্গা পুজো মানে শারদীয়া দুর্গোৎসব। হ্যাঁ, আপামর বাঙালির কাছে দুর্গা পুজো বললে শরৎ কালের শিউলির গন্ধমাখা পরিবেশে নতুন করে সেজে ওঠা। অথচ এক সময় এই বাঙালির কাছেই দুর্গা পুজো মানে ছিল বাসন্তী পুজো। কিন্তু হঠাৎ করে বাসন্তী পুজো ব্যাক সিটে চলে গেল কী করে ?

বাসন্তী পুজো বারোয়ারি কখনই ছিল না, বাসন্তী পুজো মূলত গ্রামের জমিদার বাড়ি কেন্দ্র করেই হত। বাসন্তী পুজো এখন শুধুমাত্র কয়েকটি বনেদি বাড়ি এবং প্রাচীন জমিদার বাড়িতেই সীমাবদ্ধ হয়ে রয়ে গিয়েছে। অতীতেও কিন্তু এর অন্যথা ছিল না। রামচন্দ্রের অকাল বোধনের কাহিনী বাঙালির কাছে বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছ। কৃত্তিবাসী রামায়ণে রামের অকাল বোধনের একটা সবিস্তারে বর্ণনা রয়েছে। দীর্ঘ বর্ণনা বাঙালিকে রীতিমতো পূজোর প্রতি আকৃষ্ট করেছিল। বাল্মিকী রচিত রামায়ণে কিন্তু এত দীর্ঘ এবং সুস্পষ্ট আলোচনা করা নেই। ফলে মধ্য যুগের পর থেকে বাঙালির অকাল বোধনের সময় পুজোর চল লক্ষ্য করা যায়। প্রথমে জমিদার বাড়ি কেন্দ্রিক হলেও, পরে তা বারোয়ারিতে রূপান্তরিত হয়েছে।

তবে আরও একটি কারণ রয়েছে, আগে বসন্ত কালে বহু গ্রাম বসন্ত রোগে উজাড় হয়ে যেত। ওই সময় তাপমাত্রাও অসহনীয়। তুলনায় শরৎকালের আবহাওয়া অনেক বেশি মনগ্রাহী। সব মিলিয়ে উৎসবের জন্য আদর্শ সময়।

কিন্তু তবুও বাঙালি তার আদি দুর্গাপুজোকে কোনওদিনই পুরোপুরি ভুলে যায়নি। সে এখনও দুর্গাপুজোর আদিরূপ বাসন্তী পুজোর আয়োজন করে। যদিও এই পুজো কোনও দিনই বারোয়ারির আকার নেয়নি। এই পুজো কোনও দিনই সাধারণের পুজো হয়ে ওঠেনি।এখনও এই পুজো পরিবার-তন্ত্রেই আটকে, বারোয়ারি হয়নি। এখনও এই পুজো কয়েকটি বাড়িতেই সীমাবদ্ধ থেকে গিয়েছে। সর্বজনীন উৎসবের আকার ধারণ করতে পারেনি। এখন যতই আমরা আশ্বিন মাসে দুর্গাপুজো করি না কেন, বাঙালির আদি এবং প্রকৃতি দুর্গাপুজো কিন্তু এই চৈত্র মাসেই হত।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...