পাণ্ডবদের কৌরবদের কাছে পাশা খেলায় পরাজিত হয়ে সর্বস্ব খুইয়ে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেরাচ্ছিলেন তখন যুধিষ্ঠির, শ্রীকৃষ্ণের কাছে লক্ষ্মীদেবীকে প্রসন্ন করার উপায় জানতে চান। লক্ষ্মীকে তুষ্ট করতে কৃষ্ণ পাণ্ডবদের ভাদ্রমাসের শুক্ল পক্ষের চতুর্দশীতে বিষ্ণুকে পুজো করার পরামর্শ দেন। এই পুজো করার পরই তাদের দুঃসময় কাটতে শুরু করে এবং সবশেষে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে কৌরবদের পরাজিত করে তাদের কাছ থেকে তারা সমস্ত অধিকার ফিরে পান। পুরাণ মতে, নারদ বিষ্ণুর কাছে স্বরুপ দর্শনের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। নারদের মনস্কামনা পূর্ণ করতে, সেই রূপেই দর্শন দিয়েছিলেন শ্রী বিষ্ণু। দিনটি ছিল ভাদ্র মাসের শুক্ল পক্ষের চতুর্দশী তিথি। সেই থেকে ভাদ্রমাসের শুক্ল পক্ষের চতুর্দশী হল অনন্ত চতুর্দশী। অনন্ত চতুর্দশীর দিন বিষ্ণুর অসীম রূপের পুজো করা হয়। বাংলায় অনেক জায়গাতেই অনন্তবাসুদেব মন্দির আছে। যেমন হুগলির গুড়াপ ও বাঁশবেড়িয়া।
গুড়াপের অনন্ত বাসুদেব মন্দিরটির বয়স প্রায় ২৫০ বছর। মন্দির স্থাপত্যশৈলী আটচালা প্রকৃতির। দক্ষিণ মুখী মন্দিরের সামনে নাট মন্দির রয়েছে। মন্দিরের প্রতিষ্ঠা কাল থেকেই অনন্ত বাসুদেব মূর্তি পূজিত হয়ে আসছে। মন্দিরের দেওয়ালে একটি শ্বেত পাথরের ফলক লাগানো আছে তাতে লেখা, জোলকুল নিবাসী শ্রী হরিদাস ভট্টাচার্য কর্তৃক এই মন্দির সংস্কার ও মূর্তির অঙ্গরাগ হল, ১৩০২ সাল।
এখন মন্দিরের পুজোর দায়িত্বে মুখার্জী পরিবার রয়েছে। যদিও এর আগে অন্য এক পরিবার পুজোর দায়িত্বে ছিল। জানা যায়, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু একবার এই মন্দিরে এসেছিলেন।
এই মন্দিরের অনন্ত বাসুদেবের মূর্তিটি ব্যতিক্রমী। সম্পূর্ণ দারু নির্মিত এই মূর্তি। এখানে দাদা বলরামের কোলে বালক শ্রীকৃষ্ণ শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্মধারী রূপে বিরাজমান। গাত্রবর্ণ ঘন নীল। বলরাম এখানে আকারে অনেক বড়। গাত্রবর্ণ সাদা। সিংহাসনে উপবিষ্ট। তার চৌদ্দটা হাত। তার মধ্যে বারোটা হাতে বারো রকম অস্ত্র। আর দুহাত দিয়ে সামনের দিকে শায়িত বিষ্ণুরূপী স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণকে ধারণ করে রেখেছেন। বলরামের মাথার ওপর দশটা নাগ ফনা তুলে রয়েছে, এছাড়াও মূর্তি ঘিরে রয়েছে আরও চারটি নাগ, মোট চোদ্দটি নাগ। বসা অবস্থায় বলরামের ডান পা সামান্য সামনের দিকে প্রসারিত। বলরামের মাথায় বেশ বড়ো আকারের রূপোর মুকুট, শ্রী বিষ্ণু রূপী শ্রীকৃষ্ণের মাথাতেও রূপোর মুকুট। পুরাণ অনুযায়ী আদি শেষ নাগের অবতার বা সপ্তম অবতার হলেন বলরাম। এই মন্দিরে সবকিছুই চোদ্দটা। যেমন, বলরামের চোদ্দটা হাত, তাকে ঘিরে আছে চোদ্দটা নাগ, ভোগ দেওয়া হয় চোদ্দ রকম, যারা মন্দির পরিক্রমা করে, তারাও চোদ্দবার পরিক্রমা করেন।
আবার বাঁশবেড়িয়ার অনন্ত বাসুদেব মন্দিরটি হংসেশ্বরী মন্দিরের কাছেই অবস্থিত। ১৬৭৯ সালে রাজা রামেশ্বর রায় এটি নির্মাণ করেছিলেন। মন্দিরটি উঁচু ভিত্তিবেদীর উপর প্রতিষ্ঠিত। চারচালার উপর একরত্ন বিশিষ্ট মন্দিরটির শিখরের রত্ন বা চূড়াটি অষ্টকোণাকৃতি। মন্দিরটি ইটের তৈরি। চারকোনা মন্দিরের তিনদিকে রয়েছে তিনটি তিন-খিলান। গর্ভগৃহে ঢোকার দু'টি প্রবেশদ্বারমন্দিরের পূর্বদিকে ভিত্তিবেদীর উপর একটি ফলকে লেখা রয়েছে,
"মহীব্যোমাঙ্গ শীতাংসু গণিতে শক বৎসরে।
শ্রী রামেশ্বর দত্তেন নির্ম্মমে বিষ্ণুমন্দিরং।"
'মহীব্যোমাঙ্গশীতাংসু' শব্দটির গাণিতিক অর্থ রয়েছে। মহী ১, ব্যোম ০, অঙ্গ ৬, এবং শীতাংসু অর্থাৎ চন্দ্র হল ১, অর্থাৎ মন্দিরটি ১৬০১ শকাব্দ, অর্থাৎ ইংরাজির ১৬৭৯ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এই মন্দিরের গর্ভগৃহে রয়েছে পাথরের বাসুদেব মূর্তি। চার হাত বিশিষ্ট মূর্তির হাতে শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম থাকে। মূর্তির বাম কোণে নারায়ণ ও ডান কোণে লক্ষ্মী অবস্থান করেন।