ভাদ্রের শুক্ল অষ্টমীতে শ্রীরাধার জন্ম। তাই 'রাধাষ্টমী', আসলে 'রাধা জন্মাষ্টমী'।
ব্রতরূপে 'রাধা জন্মাষ্টমী' বাংলার ব্রতমালার মধ্যে অন্তর্গত হয়েছে বহুকাল। এই ব্রত কেন ও কী-জন্য পালিত হয়, সে-ব্যাপারে একদা দেব-ঋষি নারদ প্রশ্ন করেছিলেন স্বয়ং ব্রহ্মাকে। তখন ব্রহ্মা তাঁকে একটি গল্প শুনিয়েছিলেন। সেই গল্পটিই আবার 'পদ্ম পুরাণ'-এর স্বর্গ খণ্ডের চল্লিশতম অধ্যায়ে সূত শুনিয়েছেন শৌণককে। যাই হোক, গল্পটি আরও সহজ করে এখন আমি আপনাদের শোনাব। শুনুন:
বহু বহু যুগ আগের কথা। পৃথিবী সেই সময় পাপভারে এতটাই জর্জরিত হয়ে উঠলেন যে, কিছুতেই সেই ভার সহ্য করতে না-পেরে এবং তা থেকে নিষ্কৃতি পাবার কোন উপায় না-দেখে সহায়হীনা নারীর মতো অঝোরধারায় কাঁদতে শুরু করলেন।
কাঁদতে কাঁদতে পৃথিবীর হঠাৎ মনে হল যে, মাথার ওপর পরমপিতা ব্রহ্মা তো রয়েছেন, তাঁর শরণ নিলে তিনি নিশ্চয়ই এর একটা বিহিত করবেন। কথাটা মনে হতেই অমনি একটি গাভীর রূপ ধারণ করে পৃথিবী ব্রহ্মলোকে হাজির হলেন।
ব্রহ্মার পায়ে প্রণিপাত করে কাতরস্বরে প্রার্থনা জানালেন, হে পরমপিতা, আপনি তো সৃষ্টিকর্তা, আপনার সেই সৃষ্টি আজ পাপিষ্ঠগণের পাপে বিপন্ন! আমি ধরিত্রী হয়েও সেই বিপুল পাপভার ধারণ করার, সহন করার ক্ষমতা হারিয়েছি। সৃষ্টি রক্ষা করতে, আমায় রক্ষা করতে শীঘ্রই এর প্রতিবিধান করুন!
পৃথিবীর কথার যথার্থতা উপলব্ধি করে ব্রহ্মা দারুণ বিচলিত হলেন। তিনি এও উপলব্ধি করলেন যে, প্রতিবিধান যদি কেউ করতে পারেন, তবে একমাত্র বিষ্ণুই তা পারবেন। সেই জন্য তিনি পৃথিবীকে নিয়ে রওনা দিলেন বিষ্ণুলোকে।
বিষ্ণুলোকে সৃষ্টির পালক লীলাময় বিষ্ণু তখন দেবী লক্ষ্মীর সঙ্গে রাধাকৃষ্ণরূপে বিরাজ করছিলেন। পৃথিবী ও ব্রহ্মা তাঁদের চরণ বন্দনা করে পাপভার লাঘবের জন্য আকুল প্রার্থনা জানালেন।
সব শুনে শ্রীকৃষ্ণ মৃদু হেসে জানালেন, হে ধরিত্রী উদ্বেগহীনা হও। সময় সমাগত। ধর্ম সংস্থাপনের জন্যই এবার আমি ধরণীতে অবতার নেব। কৃষ্ণ অবতার। হে ব্রহ্মদেব, আপনি ও সমস্ত দেবতারা আমার লীলাসঙ্গীরূপে মর্তে গমণ করুন। হে রাধিকে, পৃথিবীর পাপভার লাঘবের জন্য তুমিও অচিরে অবতীর্ণ হও!
দেবতারা প্রথমে মর্তে অবতরণ করলেন। তাঁদের অনুসরণ করে শ্রাবণ মাসে কৃষ্ণ পক্ষের অষ্টমী তিথিতে রাত্রিকালে কৃষ্ণ পৃথিবীর বুকে অবতার নিলেন। তারপর একমাস অতিক্রান্ত হতেই এল রাধিকার পালা।
ভাদ্র মাস। শুক্ল পক্ষের অষ্টমী তিথি। দিনের বেলা বর্ষণার রাজা বৃষভানু সন্তান লাভের আশায় এক যজ্ঞের আয়োজন করবেন বলে নিজের হাতে যজ্ঞভূমি শোধন করছিলেন। তখন সেই ভূমিতেই হঠাৎ দিব্যশিশুকন্যারূপে আবির্ভুত হলেন রাধিকা।
বলা বাহুল্য, ঈশ্বরের আশীর্বাদের মতো হঠাৎ এই দিব্যকন্যাকে পেয়ে বৃষভানু যার পর নাই আনন্দিত হলেন। অমনি পরম মমতায় কন্যাকে বুকে তুলে অন্তঃপুরে গিয়ে মহানন্দে রানির কোলে অর্পণ করলেন। জানালেন, ঈশ্বরের অযাচিত আশীর্বাদের কথা। তাই শুনে রানিরও আনন্দের সীমা রইল না।
তারপর দৈব-আদেশে কন্যার নাম 'রাধিকা' রেখে রাজারানি তাঁকে পরম যত্নে প্রতিপালন করতে লাগলেন।
ধীরে ধীরে রাধিকা যৌবনবতী হলেন। শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী হয়ে তাঁর সর্বলীলার শরিক হলেন। শ্রীকৃষ্ণ ক্রমে লীলাময়রূপে, বীরত্বের মধ্য দিয়ে, পাপীতাপীদের উদ্ধার করে ধর্ম সংস্থাপনের মধ্য দিয়ে ত্রিলোকের পরম আরাধ্য হয়ে উঠলেন। বৈষ্ণব-মণ্ডল তাঁর সেই সর্বপাপনাশী রূপটির হ্লাদিনী হিসেবে, চরম ভক্তিপথের দিশারী হিসেবে শ্রীরাধাকেও পরম আরাধ্যা হিসেবে বরণ করে নিলেন।
তারপর কত যুগ, কত কাল যে কেটে গেল তার ইয়ত্তা রইল না। দিকে দিকে কত শত নগরের পত্তন হতে লাগল। সেখানে যেমন ধার্মিক মানুষের আনাগোনা লেগে রইল, তেমনি ধর্মের ভেকধারী পুরুষের উদ্দাম আনন্দ-যাপনের জন্য নগরনটিদেরও বাড়বাড়ন্ত হতে লাগল।
সেই সময় তেমনই এক নগরে লীলাবতী নামের এক নগরনটি বাস করত। রূপের গৌরবে তার ঐশ্বর্য-অর্থের কোন অভাব ছিল না। তবুও মানুষের স্বভাব, কিছুতেই তার তৃপ্তি হয় না। তাই সে একদিন ভাবল যে, অন্য নগরে গেলে যদি তার ঐশ্বর্য আরও শতগুণ বৃদ্ধি পায়, তাহলে সে অন্য নগরে যাবে না কেন!
ফলে, একদিন সে অন্য নগরের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। সেই নতুন ও অচেনা নগরে পৌঁছে লীলাবতী অবাক হয়ে গেল। ঘরে ঘরে বৈষ্ণব নারীদের সমাবেশ। শ্রীরাধিকার মূর্তি পুষ্পমালায় সুসজ্জিত করে তারা কেউ গান গাইছে, কেউ নাচ করছে, কেউ বেণু বাজিয়ে সুর তুলছে, কেউ মৃদঙ্গে তাল দিচ্ছে। চারিদিকে যেন উৎসবের দারুণ সমারোহ জমে উঠেছে।
লীলাবতী নারীদের এভাবে উদ্বেলিত হতে কোনদিন দেখেনি। নতুন নগরের নারীদের এই উন্মাদনা দেখে তাই সে আর কৌতূহল দমন করতে পারল না। তাদেরই একজনকে জিজ্ঞেস করে বসল, এমন পাগলপারা হয়ে তোমরা কী করছ গো?
প্রশ্ন শুনে প্রথমটায় নারীরা অবাক হল; তারপর তাদেরই একজন বলল, ওমা জানো না, আজ যে ভাদ্রের শুক্ল অষ্টমী তিথি! আজই তো আমাদের রাধারানির জন্মদিন। দেবীর পুজো করতে করতে তাই আমরা অষ্টমী ব্রত করছি।
নারীটির কথা শুনে লীলাবতীর কৌতূহল আরও বাড়ল। সে জিজ্ঞাসা করল, এই ব্রত করে কী ফল লাভ হয়?
নারীটি লীলাবতীর জানবার আগ্রহ দেখে খুব খুশি হল। বলল, শোন বোন, এই ব্রত করলে সংসারে নিত্যদিন জ্ঞানে-অজ্ঞানে যত পাপ অর্জন হয়, সমস্তই বিনষ্ট হয়ে যায়। এর চেয়ে বড় ফললাভ আর কীসে হয় বলে!
কথাগুলো লীলাবতীর মনের ভেতরে দাগ কাটল। তার মনে হল, দেহব্যবসায়ে অর্থ উপার্জন করতে গিয়ে সততার পথ কবেই তো ভুলেছে সে, অর্থের লোভে দিনের পর দিন বরং অধর্ম বেড়েছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পাপের বোঝাও ভারি হয়েছে! এই বোঝা নিয়ে তাহলে তার গতি কী হবে!
লীলাবতীর বেশ ভাবনা হল। ভাবনা থেকে ভাবান্তর হতেও দেরি হল না। অমনি সে সেই নারীদের বলে বসল, দিদি, আমিও তোমাদের সঙ্গে এই ব্রত করব।
তার কথায় ব্রতীনি নারীরা খুব খুশি হল। তাকে মহাসমাদরে নিজেদের মধ্যে বসিয়ে ব্রতপালনের বিধি খুব সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিল। লীলাবতী তখন পরম ভক্তিভরে মনের মতো করে ব্রত উদযাপন করল।
পুণ্যপথে নেমে লীলাবতীর আয়ুকাল বোধহয় শেষ হয়ে এসেছিল। তাই সন্ধেবেলায় ব্রত শেষ করে সে যখন বাড়ি ফেরার পথ ধরল, তখন কয়েক পা এগোতেই অন্ধকারে সহসা এক বিষধর সাপের গা মাড়িয়ে ফেলল। অমনি সাপটি ক্রুদ্ধ হয়ে প্রবল দংশনে সমস্ত বিষ ঢেলে দিল লীলাবতীর দেহে। সেই কালান্তক বিষের জ্বালায় কয়েক মুহূর্তেই সে মারা গেল।
খানিক পরেই তাকে শেষ বিচারের জন্য নিয়ে যেতে যমদূতেরা হাজির হল। কিন্তু তারা লীলাবতীকে নিয়ে যাবার আগেই বিষ্ণুর আদেশে সেখানে হাজির হল বিষ্ণুদূতেরা। তারা বিষ্ণুর আদেশের কথা শুনিয়ে যমদূতদের বিদায় দিয়ে লীলাবতীকে সঙ্গে করে বৈকুণ্ঠে নিয়ে এল।
বৈকুণ্ঠে তখন লীলাময় বিষ্ণু ও লক্ষ্মী রাধাকৃষ্ণরূপে লীলাবতীর আগমনের জন্য স্মিতমুখে অপেক্ষা করছিলেন। লীলাবতীকে দূতেরা নিয়ে আসতেই শ্রীকৃষ্ণ খুব প্রীত হলেন এবং সমাদরের সঙ্গে বললেন, হে লীলাবতী! একদিনের ব্রতের ফলেই তোমার আজীবন অর্জিত পাপ বিনষ্ট হয়ে তুমি নির্মলা হয়েছ, দেবী রাধিকার কৃপালাভেও তুমি সমর্থ হয়েছ। তাই অনন্তকাল বৈকুণ্ঠে ইষ্ট সন্নিকটে থাকার সৌভাগ্য তুমি অর্জন করেছ। আজ থেকে এই লোকই হল তোমার একমাত্ৰ আবাস...
শ্রীকৃষ্ণের কথায় কৃতার্থ লীলাবতীর দু'চোখে আনন্দের অশ্রু বেয়ে এল, সে বার বার রাধাকৃষ্ণের চরণে প্রণিপাত করে আত্মার অর্ঘ্য নিবেদন করল। তারপর সেই সুখসদনে ইষ্টের সেবায় পরম শান্তিতে কাল যাপন করতে লাগল...