বেশভূষায় জগন্নাথ: অনুপম ঐতিহ্যের ইতিকথা: পর্ব-২২ তথা শেষ পর্ব

শ্রীজগন্নাথদেবের সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ বেশগুলির মধ্যে অন্যতম হল, 'রঘুনাথ বেশ'। এই বেশকে সবচেয়ে অপেক্ষার বেশও বলা যায়। কেননা, করব বললেই এ-বেশের আয়োজন করা যায় না। জ্যোতিষ বিচারে গ্রহ-নক্ষত্রের বিশেষ অবস্থান বিশেষ তিথিতে মিললে তবেই এ-'বেশ'-এর আয়োজন করা যায়। স্বাভাবিকভাবেই ফি-বছর তিথি-নক্ষত্রের কাঙ্ক্ষিত অবস্থান সচরাচর মেলা সম্ভব নয়। তাই এ-বেশ বাৎসরিক বা নিত্য বেশের মধ্যে পড়ে না। বিগত পাঁচশো বছরে এই বেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে মাত্র ন'বার।

জগন্নাথদেবের মধ্যে সন্তকবি তুলসী দাস যে শ্রীরামকে দেখেছিলেন, সেই গল্পটি (গল্পটি আগের পর্বে আপনাদের শুনিয়েছি) প্রচলিত থাকলেও এই 'রঘুনাথ বেশ' প্রথম কবে অনুষ্ঠিত হল, কার দ্বারা অনুষ্ঠিত হল, এবংবিধ দুটি প্রশ্নেই দ্বিমত রয়েছে :

প্রথম মত অনুযায়ী খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতকে রামানুজাচার্য্য শ্রীমন্দিরে এই 'রঘুনাথ বেশ' প্রবর্তন করেন। কারণ, এই সময় হঠাৎ-ই একদিন তিনি জগন্নাথদেবকে ধ্যানে শ্রীরামরূপে দর্শন করেছিলেন। সেই ধ্যানরূপকেই বাস্তবায়িত করতে তিনি এই বেশ প্রবর্তন করেন।

আবার দ্বিতীয় মত অনুযায়ী, 'রঘুনাথ বেশ'-এর প্রবর্তন হয় ষোড়শ শতকে।  প্রবর্তক স্বয়ং উৎকলরাজ গজপতি রামচন্দ্র দেব।

আসলে গজপতি রামচন্দ্র দেব ছিলেন শ্রীরামের একনিষ্ঠ ভক্ত। শ্রীরামই ছিলেন তাঁর একমাত্র ইষ্ট। পুরীশ্বর জগন্নাথের মধ্যেও তিনি তাঁর সেই ইষ্টকেই দেখতে চেয়েছিলেন। তাই আপন সিংহাসন আরোহনের একাদশতম বছরে শ্রীমন্দিরে তিনি 'রঘুনাথ বেশ'-এর প্রথম আয়োজন করেন। ত্রেতা যুগে চোদ্দ বছর বনবাস যাপন শেষ করে শ্রীরাম অযোধ্যায় ফিরে আসার পর যে-দিন তাঁর রাজ্যাভিষেক হয়, সে-দিনটিকেই গজপতিরাজ বেছে নিয়েছিলেন 'রঘুনাথ বেশ' আয়োজনের জন্য। দিনটি ছিল, বৈশাখ মাসের কৃষ্ণ নবমী তিথি।

তবে গজপতিরাজ শুধুই যে ইষ্টকে জগন্নাথের মধ্যে দর্শনের আকাঙ্ক্ষায় এই বেশের প্রবর্তন করেছিলেন, এমনটাও নয়। আসলে, এর মধ্য দিয়ে আপন রাজ্যশাসনের একাদশতম বছরটিকেও স্মরণীয় করে রাখতে চেয়েছিলেন। আর সে-জন্যই চৈত্র মাসের শুক্ল নবমীতে এই বেশের আয়োজন না-করে করেছিলেন বৈশাখ মাসে রাজ্যাভিষেকের দিন।

বস্তুত, সমনামী হওয়ার দরুন গজপতিরাজ এভাবে নিজের রাজত্বকে রামরাজত্বের সঙ্গে এক করে আত্মশ্লাঘা অনুভব করতে চেয়েছিলেন। আমাদের এমনটা ভাবার যথেষ্ট কারণ আছে। কেননা, এ-বছরই শ্রাবণ মাসের শুক্ল নবমী তিথিতে গজপতিরাজ নিজেকে 'ইন্দ্রদ্যুম্ন' বলে ঘোষণা করেছিলেন এবং 'রাম-অভিষেক মোহর' নামে একটি সীলমোহর জারি করেছিলেন। সেই সঙ্গে আপন নাম-সম্বলিত 'বীর রামচন্দ্রপুর শাসন' নামক একখানা গ্রামও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

ফলত, এই প্রেক্ষাপটের জন্যই 'রঘুনাথ বেশ'-এর পরিকল্পনা ও আয়োজনে গজপতিরাজ জাঁকজমকের কোন ত্রুটি রাখেননি। এই উপলক্ষে ত্রয়ী দেবদেবীর জন্য তিনি রত্নখচিত প্রচুর সোনার অলঙ্কার নির্মাণ করিয়েছিলেন, যা এখনও এই বেশকালে ব্যবহৃত হয়।

শুধু তাই নয়, অনুষ্ঠানের সময় তিনি গর্ভগৃহের রত্নবেদী থেকে কালহাট দরজা অব্দি 'রামায়ণ' বর্ণিত শ্রীরামের রাজসভার সাজে সাজিয়ে তুলেছিলেন। রীতি মেনে এখনও ঠিক এই ভাবেই সাজানো হয়। তাঁর মতো করে এখনও এই সভার উপস্থিত অতিথি, ঋষি ও সভাসদ মিলিয়ে তিরিশেরও বেশি বিভিন্ন অভিব্যক্তিযুক্ত শোলার মূর্তি স্থাপন করা হয়। মূর্তিগুলোর মধ্যে ভরত, শত্রুঘ্ন, ব্রহ্মা, বশিষ্ঠ, অঙ্গদ, জাম্বুবান, হনুমান, নল, নীল, সুগ্রীব, সুষেন প্রভৃতির মূর্তি উল্লেখযোগ্য। প্রথমবার এই বেশ সাড়ম্বরে সাতদিন ধরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, এখনও হয়।

যাই হোক, যে-বছর প্রথম এই বেশ অনুষ্ঠিত হয়, সেটি ছিল ১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দ। এর পর থেকে এখনও পর্যন্ত আর মাত্র আট বার (সব মিলিয়ে ন'বার) এই 'বেশ' অনুষ্ঠিত হবার সুযোগ পেয়েছে। দ্বিতীয়বার থেকে শেষতম সালগুলো যথাক্রমে : ১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দ, ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দ, ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ, ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দ, ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দ, ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দ, ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দ এবং ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ।

১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের পর এতদিনে এই 'বেশ' আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, এমনটা নয়। গ্রহ-নক্ষত্রের হিসেবে মেলেনি, এমনটাও নয়। কিন্তু সেই সব উদ্যোগ ও আয়োজনে কিছুতেই সফলতা আসেনি। যেহেতু এই বেশের জাঁক বেশি, চলেও সাতদিন ধরে। তাই এর আয়োজনে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয়। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে জগদানন্দ দাস নামের এক বাবাজি সরকারের কাছে 'রঘুনাথ বেশ'-এর জন্য সরকারি সাহায্য চান এবং ব্যক্তিগতভাবে অর্থ সংগ্রহের ব্যাপক প্রচেষ্টা চালান। কিন্তু ব্যর্থ হন।

বাবাজির প্রচেষ্টার এক যুগ পরে ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ একজন সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মচারি কঠিন প্রয়াস চালিয়েছিলেন অর্থসংগ্রহ করতে। কিন্তু তিনিও অবশেষে ব্যর্থ হন।

শেষমেশ নিকট অতীত ২০২০ খ্রিস্টাব্দে শ্রীমন্দির কমিটি নিজেই দায়িত্ব নেয় 'রঘুনাথ বেশ' আয়োজনের। কিন্তু হঠাৎ করে করোনা মহামারীর আবির্ভাব হওয়ায় ও তার ব্যাপক বাড়াবাড়ির ফলে দেশজুড়ে লকডাউন শুরু হয়ে যায়। স্বভাবতই দেবস্থানে ভক্ত সমাগমও পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলত, এই পরিস্থিতিতে 'রঘুনাথ বেশ'-এর আয়োজনও সম্পূর্ণরূপে বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিতে হয় মন্দির কমিটিকে।

'রঘুনাথ বেশ' অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ ও রাত্রিযাপনের বেশ। তাই একে 'শৃঙ্গার বেশ'-ও বলা হয়। এই বেশকালে জগন্নাথদের কীভাবে সাজানো হয়, বেশের জাঁকই বা কেমন--সে-সব কথা জানা যায় ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত এই বেশের বিবরণ থেকে। বিবরণটি পাওয়া যায় এই সময় প্রকাশিত 'উৎকল দীপিকা'-নামক ওড়িয়া গ্রন্থে। সেই বিবরণই বাংলা অনুবাদে বিবৃত করছি, শুনুন:

"১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ২৭ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার, বৈশাখের কৃষ্ণ নবমী তিথি। এই দিনে পুষ্যা নক্ষত্র বিশেষ অবস্থানে বিরাজ করছে। তাই এ-দিন মহাপ্রভু জগন্নাথের 'রঘুনাথ বেশ'-এর আয়োজন করা হল।

মধ্যাহ্ন ধুপ অর্থাৎ দ্বিপ্রহরের ভোগ নিবেদনের পর শুরু হল রঘুনাথ বেশের সজ্জা। সাধারণ ভক্তেরা যাতে এই বেশে প্রভুকে দর্শন করতে পারেন, সেই জন্য সন্ধ্যার ভোগ নিবেদনের পর মন্দিরের দ্বার তাঁদের জন্য খুলে দেওয়ার কথা বলা হল। তবু দরজা খুলতে খুলতে সেই রাত্রি প্রায় দশটা বেজেই গেল।

দর্শনের জন্য শ্রীমন্দির প্রাঙ্গণে কমপক্ষে পঞ্চাশ থেকে ষাট হাজার ভক্তের সমাগম হল। এই সমস্ত ভক্তের অধিকাংশই হলেন ওড়িয়া, বেশকিছু বাঙালি, আর সামান্য কিছু উত্তর ভারতীয়।

দর্শনার্থীদের সম্মুখে গর্ভগৃহ। আর গর্ভগৃহে নয়নাভিরাম দৃশ্য। সেখানে 'রঘুনাথ বেশ'-এ বড়ঠাকুর বলভদ্র সজ্জিত হয়েছেন লক্ষ্মণরূপে। আর মহাপ্রভু জগন্নাথ সুসজ্জিত হয়েছেন শ্রীরামরূপে। জগন্নাথের পাশে ভরত দাঁড়িয়ে আছেন চামর হাতে, শত্রুঘ্ন দাঁড়িয়ে আছেন রাজছত্র ধরে। বলভদ্রের ডান দিকে ব্রহ্মা ও বশিষ্ঠ অবস্থান করছেন। শ্রীদেবী সীতারূপে বসে আছেন জগন্নাথ মহাপ্রভুর কোলে। আর হনুমান হাতজোড় করে বসে আছেন জগন্নাথের ঠিক সামনে।

রত্নসিংহাসনের দু'পাশে কাঠের পাটাতন জুড়ে রাখা হয়েছে সভাসদদের জন্য আসন। তায় নির্দিষ্ট হয়েছে তাঁদের অবস্থানের স্থান। সেই স্থানে রয়েছে অঙ্গদ, বিভীষণ, নল, নীল, গবয়, গবাক্ষ প্রমুখের মূর্তি।

রত্নসিংহাসনে অপরূপা মা সুভদ্রাকেও দেখা যাচ্ছে সুসজ্জিত অবস্থায়। রাম-লক্ষ্মণরূপে জগন্নাথ ও বলভদ্র হাতে তির-ধনুক নিয়ে বিরাজ করছেন। তাঁদের হাতে বালা, বাহুতে বাজু, গলায় হার, নাকে নাকাদন্ডি শোভা পাচ্ছে। গর্ভগৃহটি দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে, এটি সেই পৌরাণিক পুরুষোত্তম রামরাজার রমণীয় সভা!"

আগেই বলেছি যে, 'রঘুনাথ বেশ' চলে সাতদিন ধরে।  এতগুলো দিন ধরে এই রাজকীয় বেশ চালানোর জন্য যেমন ব্যাপক অর্থের প্রয়োজন হয়; তেমনি প্রয়োজন হয় বিপুল সংখ্যক দর্শনার্থীর ভিড় সামলানোর মতো প্রশাসনিক পরিকাঠামোরও। সকল ভক্তেরই ইচ্ছা থাকে জীবনে একবার অন্তত এই বেশে জগন্নাথদর্শনের। ফলে, এই বিশেষ বেশের আয়োজন হলেই তা দর্শনের জন্য শ্রীমন্দিরে সারা ভারত থেকে এত বিরাট সংখ্যক দর্শনার্থীর আগমন ঘটে যে, ভিড় সামলানো মুশকিল হয়ে পড়ে। সে-কথা মাথায় রেখে সুষ্ঠু অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিকাঠামোর সম্মিলন ঘটানো অসম্ভব নয়, তবে খুবই দুরূহ কাজ।

তাই তিথি-নক্ষত্রের অবস্থান মিললেও উক্ত দুই কারণে 'রঘুনাথ বেশ' বাৎসরিক ভিত্তিতে আয়োজন করা যায় না। তাই এই বেশের জন্য ভক্তকুলের মনে যে অপেক্ষার রঙ লাগে, তা অনন্ত প্রতীক্ষায় হয়ে ওঠে অতীব প্রগাঢ়। কেননা, একশো সতেরো বছরের অপেক্ষার শেষে মারী-তিথি-নক্ষত্র-পরিকাঠামোর বাধা পেরিয়ে আর যে কবে জগন্নাথদেবকে আমরা এই বেশে দেখতে পাবো, কেউই জানি না। তবুও অপেক্ষা থাক। ওটাই সত্যি, ওটাই স্বাগত, পূরণ হলে তাই-ই হয়ে উঠবে সুন্দর...

এবার বলি শেষের কথা। শ্রীমন্দিরে জগন্নাথদেবের বিশেষ বেশভূষাকেন্দ্রিক আমাদের যে পরিক্রমা আমরা শুরু করেছিলাম, 'রঘুনাথ বেশ'-এর মধ্য দিয়েই সেই পরিক্রমা শেষ হল। তাই প্রায় এক বছর ধরে পর্বে পর্বে প্রবাহিত এই ধারাবাহিকের এটিই শেষ পর্ব। সহৃদয় পাঠকবৃন্দ, আপনারা এই সময়কালে ভালোবাসা দিয়ে সাহচর্য দিয়ে লাইক-শেয়ারের মাধ্যমে প্রবল উৎসাহ দিয়ে যে-ভাবে এই ধারাবাহিককে এগিয়ে যেতে প্রেরণা দিয়েছেন, তার জন্য আপনাদের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। বিদায়। তবে বিদায় মানেই শেষ দেখা নয়।শিগগিরই দেখা হবে নতুন ধারাবাহিকের প্রবাহে। আশা করব, তখনও এভাবেই পাশে থাকবেন, উৎসাহ দেবেন, প্রেরণা হবেন...নমস্কার!

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...