শ্রীমন্দিরে শ্রীজগন্নাথের যে সকল বিশেষ বেশভূষা অনুষ্ঠিত হয়, তাদের মধ্যে সর্বশেষ ও সবচেয়ে আকর্ষণীয় বেশটির নাম হল, 'রঘুনাথ বেশ'। শ্রীরাম ও শ্রীজগন্নাথ যে একই লীলাময়ের দুই রূপ-ভক্তদের সামনে এটা তুলে ধরাই হল এই বেশের উদ্দেশ্য। এই বেশের অন্দরে একটি কিংবদন্তি রয়েছে, সেটি প্রথমে পরিবেশন করছি, শুনুন:
পুণ্যভূমি কাশীধামের বিখ্যাত গোঁসাই তুলসী দাস। তিনি শুধু শ্রীরামের ভক্ত নন, রাম-সরণির নিছক কোন সন্তও নন, তিনি রামকথার অপূর্ব এক কথাকার। অনন্য কথাকাব্য 'রামচরিত মানস'-এর রচয়িতা।
সেই তুলসী দাস একদিন স্বপ্নে দেখলেন যে, পুরীধামের শ্রীমন্দিরের রত্নময় সিংহাসনে ভুবনভোলানো রূপে জগতকে বিমোহিত করে বসে আছেন স্বয়ং শ্রীরাম। তাঁর হাতে ধনুক, তূনে তির, মুখে প্রশান্ত হাসি, সর্বাঙ্গে মঙ্গলময় জ্যোতি! শ্রীরামের সেই অপরূপ রূপ হতে কিছুতেই যেন চোখ ফেরানো যাচ্ছে না! সেই রূপের আলোয় অন্তরলোক অনাদি আনন্দে কেবলই ভরে উঠছে, ভরেই উঠছে...
সেই আনন্দে ভক্তশ্রেষ্ঠ তুলসী দাস যখন বিমোহিত হয়ে বিভোর হচ্ছিলেন, ঠিক তখনই তাঁকে অতৃপ্ত করে স্বপ্নটি হঠাৎ ভেঙে গেল। ধড়মড় করে বিছানায় তিনি উঠে বসলেন। আর বসেই শুরু হল ইষ্টকে অমন আনন্দময় রূপে প্রাণ ভরে দেখতে না-পারার অতৃপ্তিতে উচাটন। মনে হল, এ-অতৃপ্তি নিয়ে কালক্ষয় করা তো দূরের কথা, বাঁচাই অসম্ভব। প্রভাত হলেই তিনি পদব্রজে রওনা দেবেন শ্রীক্ষেত্রের উদ্দেশ্যে। তারপর শ্রীমন্দিরে গিয়ে ইষ্টকে সাক্ষাৎ দর্শন করে তৃপ্ত হবেন।
প্রভাতের প্রতীক্ষায় সারারাত আর অধীর তুলসী দাসের চোখে ঘুম এল না। কাকভোরে যখন রাত্রির শেষ প্রহরের কাকলি শুরু হল, তখনই আর কালবিলম্ব না-করে তিনি শ্রীক্ষেত্রের পথ ধরলেন। শুরু হল তাঁর ক্লান্তিহীন পথ চলা।
সুদূর সে-পথ চলতে চলতে কেটে গেল কয়েকটা দিন। এক সময় এসে পৌঁছলেন কটকে। কটক থেকে ধরলেন ভুবনেশ্বরের পথ। পথে নামল সন্ধ্যা। বিশ্রামের জন্য থামলেন এক সরোবরের পাড়ে। (লোকমুখে একদিন এই সরোবরেরই নাম হল, 'তুলসী সরোবর')।
সরোবরের পাড়ে রাত কাটিয়ে পরদিন সকালে আবার শুরু হল যাত্রা। এ-যাত্রায় এ-দিনই উপনীত হলেন তিনি পুরীধামে। বড় আশা নিয়ে বাইশখানা সিঁড়ি ভেঙে এসে দাঁড়ালেন গর্ভগৃহের সামনে। কিন্তু কই, রত্নসিংহাসনে তাঁর স্বপ্নে দেখা রামচন্দ্র তো নেই! তাঁর জায়গায় সেখানে পূজিত হচ্ছেন হস্তপদকর্ণবিহীন এক দেবতা! তাই দেখে তুলসী দাস দারুণ হতাশ হয়ে পড়লেন। তাঁর সমস্ত আশা বিফল হল, সমস্ত শ্রম জলাঞ্জলি গেল! স্বপ্নে প্রভু তাঁকে এ কেমন ছলনা করলেন! কেনই বা করলেন!
তুলসী দাসের ভারি অভিমান হল। সেই অভিমানে তিনি শ্রীবিগ্রহের দিকে পিছন ফিরলেন। তারপর ঝটিতে আঠারো-নালা সেতুতে এসে পৌঁছলেন। সেতুর ওপর ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের ইচ্ছেয় যে পরমভক্ত হনুমান তাঁর পথ রোধ করতে লেজ প্রসারিত করে বসে আছেন, অভিমানতাড়িত তুলসী দাস সেটা খেয়ালও করলেন না। লেজ ডিঙিয়ে সোজা নেমে এলেন কাশীধামের পথে। পথে পড়ল মালতিপটপুর গ্রাম। সেখানে নামল রাত্রি।
রাত্রিযাপনের জন্য তুলসী দাস এই গ্রামে থামলেন বটে, কিন্তু অভিমানে কারও বাড়িতে আশ্রয় নিলেন না। ক্ষুধায়-তৃষ্ণায় তিনি যৎপরোনাস্তি কাতর, তথাপি কারও কাছে চেয়ে খেলেন না। সেই অবস্থাতেই আশ্রয় নিলেন একটি পরিত্যক্ত উঠোনের ভগ্ন তুলসীতলায়। অপরিসীম ক্লান্তিতে গায়ের কাপড় পেতে সেখানেই খানিক শুলেন। আর শুতেই শ্রান্তিবশত অল্পক্ষণেই ঘুমিয়ে পড়লেন।
ঘুমোতেই অবিলম্বে তাঁর চোখে স্বপ্ন এল। স্বপ্নে দেখলেন যে, স্বয়ং দেবী মহালক্ষ্মী সেই হস্তপদকর্ণহীন দেবতাকে বলছেন, হে প্রভু, শ্রীক্ষেত্র থেকে কোন ভক্তই তো মহাপ্রসাদ গ্রহণ না-করে তৃপ্ত না-হয়ে ফেরেন না। কিন্তু, আপনার পরমভক্ত তুলসী যে আজ অভুক্ত অবস্থায় তৃষ্ণা আর অতৃপ্তি নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন! তার কী হবে!
মহালক্ষ্মীর কথা শুনে প্রভুর মুখে ফুটে উঠল রহস্যময় অথচ প্রশান্ত এক হাসি। সেই হাসি দেখে মহালক্ষ্মী কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই হঠাৎ তুলসী দাসের ঘুমটি ভেঙে গেল।
আসলে তুলসী দাসের ঘুম ভাঙল ফুটফুটে একটি বালকের ক্রমাগত নাড়ায়। নাড়া খেয়ে তুলসী চমকে চোখ খুলেই দেখতে পেলেন তার হাসি হাসি মুখটি। সেই হাসি যেন স্বপ্নের ঠাকুরটির মতোই প্রশান্ত আর শান্তিদায়ী।
তুলসী উঠে বসলেন। দেখলেন, বালক একটি প্রদীপ এনে নামিয়ে রেখেছে তুলসীতলায়। তাতে সম্মুখের অন্ধকার খানিকটা ফিকে হয়েছে। তুলসী দাস এবার দেখতে পেলেন, বালকের হাতে ভাত ও ব্যঞ্জনের থালা।
তুলসী দাসের সম্মুখে থালাটি নামিয়ে বালক বলল, মন্দির থেকে অমন করে চলে আসতে হয়? তোমার বাড়িতে এসে কেউ যদি খিদে-তেষ্টা নিয়ে চলে যায়, তোমার ভালো লাগবে, বলো? আমার তো খুব খারাপ লাগছিল। তাই মন্দির থেকে মহাপ্রসাদ নিয়ে তোমায় খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসেছি। নাও, এবার খেয়ে নাও তো লক্ষ্মী ছেলের মতো...
অতটুকু একটি ছেলের মুখে অমন পাকা পাকা কথা শুনে তুলসী দাস মৃদু হাসলেন। কিন্তু তাঁর অভিমান গেল না। তিনি বললেন, ভগবান রামচন্দ্রকে আমি যেমন করে দেখতে চাই, শ্রীমন্দিরে তেমন করে না-দেখে তো আমি মহাপ্রসাদ গ্রহণ করতে পারব না বাবা! যাও, রাত করো না, বাড়ির লোক ভাববে, তুমি বরং ঘরে ফিরে যাও!
বালক কিন্তু ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে কোন আগ্রহই দেখাল না। তুলসী দাসের কথায় হতাশও হল না। বরং তাঁর সঙ্গে তর্ক জুড়ে বলল, তুমি বাপু তোমার ইষ্টকে যেমন করে দেখতে চেয়েছ, তেমন করেই তো তিনি তোমায় দর্শন দিয়েছেন। অভিমানের জ্বালায় তুমিই তাঁকে চিনতে পারোনি-
বালকের কথা শেষ হতে দিলেন না তুলসী দাস। কথার মাঝে সবিস্ময়ে বলে উঠলেন, চিনতে পারিনি! তুমি জানো, আমি কোন রূপে তাঁকে দেখতে চেয়েছিলাম?
বালক পরম বিশ্বাসে ধীরে ধীরে বলল, শুধু আমি কেন, যাঁরা তোমার পুঁথি পড়েছেন, শ্রীরামের সেই সমস্ত ভক্তজনের সক্কলেই সে-কথা জানেন। তুমিই তো 'রামচরিত মানস'-এ বালকাণ্ডের একশো সতেরোতম দোঁহার পঞ্চম থেকে অষ্টম চৌপাইতে লিখেছ-
"বিনু পদ চলই শুনই বিনু কান
কর বিনু কর্ম করই বিধি নান
আনন রহিত সকল রসভোগী
বিনুবাণী বকত যোগী
তন বিনু পরশ নয়ন বিনু দেখ
গ্রহই ঘ্রাণ বিনু বাস অশেষ
অসিসম ভাতি অলৌকিক কারণ
মহিমা জাসু যায় নাহিন বরন।।"
এতগুলো শ্লোকে তুমিই তো বলেছ যে, রামচন্দ্র আসলে পরমব্রহ্ম। আর পরমব্রহ্ম তো তিনিই, যিনি পদবিশিষ্ট না-হয়েও ব্রজন করতে পারেন, কর্ণবিশিষ্ট না-হয়েও সবকিছু শুনতে পারেন, হস্তবিশিষ্ট না-হয়েও বহুবিধ কর্ম করতে পারেন, জিহ্বাযুক্ত না-হয়েও সবকিছুর স্বাদ নিতে পারেন, ইন্দ্রিয়াতীত হয়েও সবকিছুকে স্পর্শ করতে পারেন, বাহ্যচক্ষু না-থাকতেও সমস্তই দর্শন করতে পারেন, নাসিকা ছাড়াও সমস্ত রকমের সুবাস গ্রহণ করতে পারেন। পরমব্রহ্ম আসলে অপূর্ব রহস্যময়তার আধার, মরমী ভক্তের উপাস্য দেবতা। শ্রীমন্দিরে তুমি যে হস্তপদকর্ণবিহীন দেবতাটিকে পূজিত হতে দেখেছ, তাঁর নাম জগন্নাথ। একবার ভেবে দেখ তো, তাঁর সঙ্গে তোমার ওই সকল ব্রহ্ম-তুলনা মেলে কি না!
বালকের কথায় তুলসী দাসের হঠাৎ করেই যেন চোখ খুলে গেল। সত্যিই তো রামচন্দ্রকে ভক্তের কল্পনায় তিনি যেভাবে দেখতে চেয়েছিলেন, শ্রীমন্দিরে জগন্নাথরূপে রামচন্দ্র তো তাঁকে সেভাবেই দেখা দিয়েছেন! জগন্নাথই তো রামচন্দ্রের ব্রহ্মস্বরূপ। অথচ স্বপ্নের দেখা দেখতে গিয়ে তুলসী দাস তাঁর ইষ্টকেই কি না চিনতে পারলেন না! এই পরম সত্যিটা উপলব্ধি করে বড় অনুশোচনা জাগল তাঁর মনে। মনে হল, ওভাবে মন্দির থেকে চলে আসা উচিত হয়নি। মনে হল, পরমব্রহ্মের কাছে সেই জন্য তাঁর ক্ষমা চাওয়া উচিত।
অমনি তিনি সেখান থেকে উঠে আর কিছু না-বলে সোজা হাঁটা দিলেন শ্রীক্ষেত্রের শ্রীমন্দির পানে।
এদিকে তুলসী দাসের এই ভাবান্তর দেখে বালকটির মুখে দেখা গেল পরমেশ্বরের সেই রহস্যময় হাসি। আবেগের আতিশয্যে তুলসী দাসের জানার সুযোগ হল না ভাবার সময় হল না যে, বালকটি কোন সাধারণ বালক নন, স্বয়ং শ্রীজগন্নাথ। ভক্তের জন্য আহার-বাহক হয়ে সত্যের বাহক হয়ে তিনি ভক্তের কাছে এসেছিলেন। ভক্তের সেবা করতে, ভক্তকে কৃপা করতে। তিনি এমনই কৃপালু, এমনই ভক্তবৎসল।
ওদিকে আকুল হয়ে শ্রীমন্দিরে পৌঁছে গর্ভগৃহে এসে তুলসী দাস তো অবাক। রত্নসিংহাসনে এখন জগন্নাথ নেই। তাঁর পরিবর্তে সেখানে বসে আছেন স্বয়ং রামচন্দ্র। তাঁর হাতে ধনুক, তূনে তির, মুখে প্রশান্তির হাসি, অঙ্গে মঙ্গলময় জ্যোতি। যেমনটি তুলসী দাস স্বপ্নে দেখেছিলেন, ঠিক তেমনটি তাঁর রূপ। তিনি ধন্য হলেন। তৃপ্ত হলেন।
সেই তৃপ্তি নিয়ে তুলসী মুগ্ধ চোখে অনেকক্ষণ চেয়ে রইলেন ইষ্টের পানে। তারপর বিড়বিড় করে বললেন, এবার তোমায় চিনেছি প্রভু। তুমিই জগতের নাথ, তুমিই আমার রঘুনাথ। আর ভুল হবে না। আমার অজ্ঞান-অপরাধ ক্ষমা করো প্রভু, এই দীন ভক্তকে তুমি ক্ষমা করো...!-বলতে বলতে তুলসী দাসের চোখের জলে বুক ভাসল। সেই জলে ভেসে গেল সমস্ত অভিমান। হল ভক্ত ও ভগবানের অপূর্ব মিলন।
এভাবেই শ্রীমন্দিরে জগন্নাথের কৃপা পেয়ে ধন্য হয়ে তৃপ্ত হয়ে কাশীধামে ফিরেছিলেন তুলসী দাস। আর এই কৃপার কথা স্মরণ করেই ষোড়শ শতকে সূচনা হয়েছিল জগন্নাথের 'রঘুনাথ বেশ' নামক জাঁকজমকপূর্ণ বিশেষ সজ্জার। আজ নয়, সেই বিশেষ সজ্জার চমকপ্রদ বিবরণ শোনাব আগামি পর্বে। সুতরাং, আজ এই পর্যন্তই...