বেশভূষায় জগন্নাথ: অনুপম ঐতিহ্যের ইতিকথা: পর্ব-২০

অঘ্রান মাসের শুক্ল ষষ্ঠী থেকে শ্রীমন্দিরে জগন্নাথদের 'ঘোডা লাগি বেশ'-এর মাধ্যমে শীতের পোশাক পরানোর ধারা শুরু হয়েছিল। মাঘ মাসের শুক্ল পঞ্চমীতে সেই ধারার পরিসমাপ্তি ঘটে।

কেননা, এই সময় শীতকে বিদায় জানিয়ে ঋতুচক্রে এসে পড়ে বসন্ত। তবে, বসন্ত এসে গেলেও প্রকৃতিতে এই সময় শীতের আমেজ খানিক থেকেই যায়। ফলে তার রেশ লাগে ভগবানের পোশাক-ভাবনাতেও। তাই এই সময় শ্রীমন্দিরে জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রাকে সিল্ক কাপড়ের নতুন ও বিশেষ সাজবেশে সুসজ্জিত করা হয়।

এই নতুন ও বিশেষ সাজবেশটির নাম হল, 'জামা লাগি বেশ'। মাঘের শুক্ল পঞ্চমীতে শুরু হয়ে ফাল্গুন/চৈত্রের দোল পূর্ণিমা অব্দি এই বিশেষ বেশের ধারাটি অব্যাহত থাকে।

এই বেশে জগন্নাথদের শ্রীঅঙ্গে সিল্কের কাপড় জামার মতো পেঁচিয়ে পরানো হয়। আর তার জন্য ব্যবহৃত হয় ছয় হাত মাপের চারখানা করে কাপড়। সপ্তাহের সাতটি দিনের জন্য কাপড়ের সাতটি আলাদা রঙ নির্দিষ্ট রয়েছে।

বেশকর্মটি অনুষ্ঠিত হয় 'অবকাশ নীতি' সমাপ্ত হওয়ার পর। অর্থাৎ, সকালে জগন্নাথদের ঘুম থেকে ওঠা, মুখ ধোয়া ও স্নান সম্পন্ন হওয়ার ঠিক পরই।

বেশকালে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা আদি ত্রয়ী দেবদেবীর মুখ চক্রাকারে বস্ত্রদ্বারা সুসজ্জিত করা হয়, এই সজ্জাকে বলা হয়, 'শ্রীমুখ বালা'। এই সময় তাঁদের অঙ্গে ওঠে হালকা রঙের সুদৃশ্য বস্ত্র। এই বেশ 'দ্বিপ্রহর ধুপ' অর্থাৎ দুপুরের আহার অব্দি শ্রীঅঙ্গে শোভা পায়। আহারের পরই অবশ্য এই বেশ বদলে দেওয়া হয়।

এবার আসি অলঙ্কার-সজ্জার কথায়। আশ্বিন মাসে 'রাধা দামোদর বেশ'-এর সময় যে যে অলঙ্কার ব্যবহৃত হয়েছিল, 'জামা লাগি বেশ'-এর সময় সে-সবেরই দেখা মেলে। তাই এই সময় ত্রিদেবদেবীর গলায় পরানো হয় তিন খানা করে সোনার হার। হাতে পরানো হয় একজোড়া করে সোনার ‘নালিভুজ’ নামের গয়না। এছাড়া মণিবন্ধে ‘ওদিয়ানি’ পরানো হয়। আর পরানো হয় সোনার ‘তিলকিয়া’। সমস্ত মিলিয়ে তিন দেবদেবীর প্রত্যেককেই পরানো হয় মোট তিরিশ রকমের সোনার গয়না। 

'জামা লাগি বেশ' চলতে চলতে এসে পড়ে ফাল্গুন মাস। এই মাসেও জগন্নাথদের একটি বিশেষ বেশ অনুষ্ঠিত হয়। বেশটির নাম, 'চাচেরি বেশ'। ফাল্গুনের শুক্ল দশমী থেকে শুরু করে দোল পূর্ণিমা অব্দি এই বেশ অনুষ্ঠিত হয়।

'চাচেরি বেশ'-এ ভাইবোনের সঙ্গে জগন্নাথদেব পা থেকে মাথা পর্যন্ত লাল বস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে ওঠেন। 'লাল' দোলের রঙ, ফাগের রঙ। তাই 'চাচেরি বেশ' জগন্নাথের দোল খেলার বেশ। এই বেশে কৃষ্ণের মতো জগন্নাথও সহচরীদের সঙ্গে দোল খেলেন। আসলে, জগন্নাথই যে কৃষ্ণ, ভক্তদের সেটা মনে করিয়ে দিতেই এই বেশের অবতারণা।

'চাচেরি বেশ' হল মধ্যাহ্নকালীন বেশ। শ্রীমন্দিরে মধ্যাহ্ন ধুপ বা মধ্যাহ্নের নৈবেদ্য নিবেদন করা হয়ে গেলে নিয়মমতো মৈলম বা বস্ত্র-পরিবর্তনের রীতিটি অনুষ্ঠিত হয়। আর তারপরই শুরু হয় 'চাচেরি বেশ'-এর অনুষ্ঠান।

অনুষ্ঠানের প্রথমেই শ্রীমন্দির প্রাঙ্গণে অবস্থিত ভূদেবী ও শ্রীদেবীকে তাঁদের নিজস্ব মন্দির থেকে সসম্মানে জগন্নাথের রত্নসিংহাসনে আনা হয়। তাঁদের সঙ্গে সেখানে আসেন জগন্নাথের ছলনমূর্তি বা প্রতিনিধি মূর্তি দোলগোবিন্দও। তাঁরা সকলে রত্নসিংহাসনে অধিষ্ঠিত হলে 'পূজাপাণ্ডা', 'পতি-মহাপাত্র' ও 'মুদিরাস্তা' নামের সেবায়েতরা শুরু করেন চন্দনলাগি অনুষ্ঠান।

এই অনুষ্ঠানে তিন সেবায়েত শ্রীদেবী, ভূদেবী ও দোলগোবিন্দের গায়ে সুন্দর করে সুগন্ধী চন্দনবাটা লাগিয়ে দেন। তারপর তাঁদের নিয়ে যান দক্ষিণের ঘরে।

এদিকে তখন রত্নসিংহাসনে জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রাকে আপাদমস্তক লাল বস্ত্রে সুসজ্জিত করার কাজ শুরু হয়। এতে ব্যবহৃত হয় দুই ধরণের কাপড়। একটির নাম, 'বৈরণী'; অন্যটির নাম, 'মাধবালি'। বস্ত্রের সঙ্গে দেবদেবীরা পরিধান করেন প্রভূত সুদৃশ্য সোনার অলঙ্কার। কানে পরেন চারখানা করে কুণ্ডল, ধারণ করেন দু'খানা করে তদগি। সেই সঙ্গে ধারণ করেন সুন্দর সুগন্ধী ফুলের মালা ও বিবিধ অলঙ্কার।

ওদিকে ওই একইরকমভাবে সুসজ্জিত হয়ে দক্ষিণের ঘর থেকে শ্রীদেবী, ভূদেবী ও দোলগোবিন্দ ফিরে আসেন রত্নসিংহাসনে। তাঁরা এলে তারপরই শুরু হয় 'কর্পূর লাগি' অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানে দেবদেবীদের অঙ্গে কর্পূর লেপন করা হয়। এর মধ্য দিয়েই সম্পূর্ণ হয় বেশভূষা।

বেশভূষা সম্পূর্ণ হতেই শুরু হয় 'ফাগু লাগি' অনুষ্ঠান। পূজা পাণ্ডা, পতি মহাপাত্র ও মুদিরাস্তা সেবকেরা শ্রীদেবী, ভূদেবী ও দোলগোবিন্দের গায়ে ফাগ লাগিয়ে প্রথমে বন্দনা করেন। তারপর তাঁদের নিয়ে বেরিয়ে পড়েন দোলযাত্রায়। গর্ভগৃহ থেকে বেরিয়েই তাঁরা হাজির হন শ্রীমন্দিরের জয়া-বিজয়া দ্বারে। সেখানে আর-এক প্রস্থ 'ফাগু লাগি' বেশ ধুমধামের সঙ্গে যাপন করে তিন দেবদেবী পালকি চড়ে সোজা হাজির হন গিয়ে জগন্নাথ-বল্লভ মঠে।

মঠে এসে ভক্তদের সঙ্গে আবারও দোল খেলায় মত্ত হন দোলগোবিন্দ। খেলা সমাপ্ত হলে দুই সহচরীসহ পালকিতে পাড়ি দেন বেন্ত পুকুরের উদ্দেশ্যে।

বেন্ত পুকুরে দোলগোবিন্দ খানিক আনন্দযাপন করেন। এখানে তাঁকে আনন্দ দেওয়া হয় শিকারের মহড়া দেখিয়ে। তার জন্য সামনে রাখা থাকে তির আর ধনুক। খানিক দূরে সারি দিয়ে রাখা হয় ছ'খানা নারকেল। ভিতরচা মহাপাত্র তির-ধনুক ত্রিদেবদেবীর চরণস্পর্শ করানোর পর তা গ্রহণ করেন ডালা বেহেরা বা লেংকা সেবকদের কেউ একজন। তিনি ধনুকে তির যোজনা করে ছ'টি নারকেলের মধ্যে পাঁচটি বিদ্ধ করেন, একটিকে করেন না। যেটি করেন না, সেটিকে সঙ্গে করে ত্রিদেবদেবীকে নিয়ে শ্রীমন্দিরে ফেরেন। 

শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে শ্রীজগন্নাথের দোলযাত্রার ফারাক একটাই। সেটা হল, শ্রীকৃষ্ণ শুধু দোল পূর্ণিমার দিন অর্থাৎ একদিন দোল উৎসব যাপন করেন; কিন্তু জগন্নাথ দশমী থেকে পূর্ণিমা--এই ছ'দিন দোল উৎসবে মেতে থাকেন। শেষ দিন আগামি আষাঢ়ে যে রথযাত্রা হবে, সেই রথ নির্মানের কাঠ সাড়ম্বরে পুজো করা হয়।

বলা বাহুল্য, দোল উৎসব উপলক্ষে কিন্তু শ্রীমন্দিরে জগন্নাথের উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয় বিশেষ ভোগ। এই ভোগের নাম, 'চাচেরি ভোগ' বা 'দোলযাত্রা ভোগ'। এই ভোগে থাকে 'চিঁড়ে ভাজা', 'চিঁড়ে পোহা', 'ইকাপাগি উখুড়া', 'উখুড়া মুয়ান', 'নাডিয়া পাতি', 'চিঁড়ের নাড়ু', 'খাজা', 'সকরা', 'ভাজা চানা', 'গজা মুগ বা অঙ্কুরিত মুগ' এবং 'কলা' প্রভৃতি এই সময়ের ফল। সঙ্গে থাকে 'পঞ্চামৃত', 'গুড় জল', 'ছানা', 'লাল আবির বা ফাগ', ঘিয়ে ভেজা তুলো জড়ানো নারকেল কাঠি, 'ধূপকাঠি', 'কর্পূর' ও 'চন্দনবাটা'।

এই 'চাচেরি বেশ' অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই শ্রীমন্দিরে শেষ হয় ফাল্গুন মাসের বিশেষ বেশভূষা। তাই সেই সঙ্গে আমরা এখানেই শেষ করছি আজকের পর্বটিও। আগামি পর্বে নিয়ে আসব চৈত্র মাসের বিশেষ বেশভূষার কথা ও কাহিনি...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...