মাঘ মাসের পূর্ণিমা তিথি। উত্তর ভারতে গঙ্গাতীরের পুণ্যার্থীরা এ-দিন যখন গঙ্গার জলে অবগাহন করে চন্দ্রদেবের পুজোর মধ্য দিয়ে মোক্ষের সন্ধান করেন, তখন শ্রীক্ষেত্রের শ্রীমন্দিরে জগন্নাথের একটি বিশেষ সাজবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এই সাজবেশের নাম, 'গজ উদ্ধারণ বেশ'। বেশের বিবরণ শোনানোর আগে শোনাবো এর প্রেক্ষাপটে প্রচলিত এক পৌরাণিক কাহিনি।
কাহিনিটি 'ভাগবত পুরাণ'-এ পাওয়া যায়। শুনুন :
পুরাকালে ইন্দ্রদ্যুম্ন নামে এক রাজা ছিলেন। তিনি ছিলেন ভগবান বিষ্ণুর পরম ভক্ত। নিত্য পুজোয়-দানে-ধ্যানে দিন কাটাতেন। তা সত্ত্বেও, একদিন অহংকার তাঁকেও এসে প্রবলভাবে ঘিরে ধরল। এবং, সেই অহংকারই একদিন তাঁকে নিয়ে গেল সর্বনাশের চরম পথে।
সেদিন রাজা বসে আপন সভায়। সভার কাজ চলছে। এমন সময় সেখানে উপস্থিত হলেন অগস্ত্য মুনি। কিন্তু রাজকার্যে রাজা এমনই ডুবে ছিলেন যে, অগস্ত্য মুনিকে দেখেও দেখলেন না। তাঁর পদবন্দনা করলেন না বা উঠেও দাঁড়ালেন না। এতে স্বাভাবিকভাবেই অগস্ত্য যার-পর-নাই অপমানিত হলেন এবং ভয়ানক ক্রুদ্ধ হলেন। ক্রোধের বশে দিয়ে বসলেন মারাত্মক এক অভিশাপ। বললেন, রাজা যেহেতু হস্তিপ্রমাণ অহং নিয়ে তাঁকে উপেক্ষা ও অপমান করলেন, তাই রাজা অচিরেই হস্তীরূপে জন্ম নেবেন!
অভিশাপবাণী উচ্চারিত হতেই সম্বিত ফিরল রাজার। স্তব্ধ হল সভা। রাজা নিজের ভুল বুঝতে পেরে অগস্ত্যর পায়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করে বারংবার ক্ষমা চাইতে লাগলেন। অগস্ত্য তাতে অবশ্য শান্ত হলেন। ক্ষমা করলেন।
কিন্তু অভিশাপ একবার দেওয়া হয়ে গেলে তো আর ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। তাই অগস্ত্য ক্ষমাসুন্দর আশীর্বাদ করে বললেন, হে রাজন, হস্তীরূপে তোমাকে জন্ম নিতেই হবে, কিন্তু সুকৃতিবসত তুমি হস্তী হয়েও হবে বিষ্ণু ভক্ত। তোমার ইষ্টই তোমায় উদ্ধার করবেন।
কথা শেষ করে অগস্ত্য আপন আশ্রমে ফিরে গেলেন। আর তারপরই মুনির বচন সত্য করতে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন তনু ত্যাগ করলেন। এবং ত্রিকূট পর্বতের উপবনে জন্ম নিলেন হস্তীরূপে। সেখানেও খানিক বড় হতেই একদিন তিনি হয়ে উঠলেন হাতিদের রাজা। গজরাজ। এবং অবশ্যই হলেন পরম বিষ্ণুভক্ত।
গজরাজ প্রতিদিন ত্রিকূট পর্বতের এক সরোবরে যান, নিজের শুঁড়ে প্রস্ফুটিত পদ্ম তুলে এনে বিষ্ণুকে নিবেদন করেন, তারপর আহার গ্রহণ করেন। এমনি করে দিন যায়।
একদিন সরোবরে পদ্ম তুলতে এসে ঘটে গেল নিদারুণ বিপত্তি। কারণ, সেদিনই সরোবরের জলে কোথা থেকে বিঘৎ আকারের রাক্ষুসে এক কুমীর এসে জুটেছিল। গজরাজ তো আর সে-কথা জানতেন না, তাই পরম নিশ্চিন্তে পদ্ম তুলতে জলে নামলেন। কিন্তু শুঁড় দিয়ে একখানা পদ্ম তুলে যেই না পাড়ে উঠতে গেলেন, অমনি হঠাৎ করে কুমীরটি এসে তাঁর পিছনের পায়ে সজোরে কামড়ে ধরল। শুধু কামড়ে ধরলই না, তাঁকে গভীর পাঁকে এনে মেরে ফেলার জন্য প্রবল টান দিতে লাগল।
হঠাৎ এই আক্রমণে প্রথমটায় হতভম্ব হয়ে গেলেও সম্বিৎ পেয়ে বাঁচার জন্য প্রবল লড়াই শুরু করলেন গজরাজ। ক্রোধে ও সুতীব্র যন্ত্রণায় শুরু করলেন প্রচণ্ড চিৎকার। সেই চিৎকারে ছুটে এল তাঁর পরিবার-পরিজনেরা।
কিন্তু সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রবল প্রতিরোধ সত্ত্বেও সেই রাক্ষুসে কুমীরের কবল থেকে নিজেকে কিছুতেই উদ্ধার করতে পারলেন না গজরাজ। ক্রমে নিস্তেজ হয়ে পড়লেন। তাঁকে নিস্তেজ হতে দেখে পরিবার-পরিজনেরা হতাশ হয়ে পালিয়ে গেল, রাক্ষুসে কুমীরের ভয়ে কেউই তাঁকে উদ্ধারের জন্য জলে নামল না!
গজরাজ এই চরম সংকট মুহূর্তেই উপলব্ধি করলেন রাজপাট, সংসার, পরিজন--সমস্তই আসলে অসার! বীতশ্রদ্ধ মনে প্রশ্ন জাগল, তাহলে আর বাঁচবেন কার জন্য, কীসের জন্য! উপলব্ধির এই স্তরেই উত্তরও পেলেন মনে। জীব শুধু নিজের জন্য, জীবের জন্যই বাঁচে না, ইষ্টের জন্যও বাঁচে। তাঁকেও সেভাবেই বাঁচতে হবে। তাই কাতরভাবে তিনি ইষ্টেরই শরণ নিলেন। শুঁড়ের পদ্ম সেই ইষ্টের উদ্দেশ্যে নিবেদন করে তাঁকে স্মরণ করলেন।
ভক্তের এই অকুতিমাখা আবাহনে বৈকুণ্ঠে ইষ্টের আসন টলল। ভক্তিতে প্রীত হয়ে ভগবান বিষ্ণু তখন গরুড়বাহনে ছুটে এলেন ভক্তের কাছে। বরাভয় দান করে আপন করাল সুদর্শনে খণ্ড খণ্ড করে কেটে ফেললেন কুমীরকে। সরোবরের জল কুমীরের রক্তে লালে লাল হয়ে গেল। কুমীরটি মৃত্যুবরণ করল। সেই সঙ্গে তার কবল থেকে উদ্ধার পেলেন গজরাজও।
কুমীর মারা গেলে তার মধ্য থেকে করজোড়ে আবির্ভুত হলেন গন্ধর্বরাজ হুহু। আসলে, তিনিই অভিশপ্ত হয়ে কুমীর জন্ম নিয়েছিলেন। তাঁর অভিশাপ নেমে এসেছিল যেভাবে, তার মুলেও আছে এক কাহিনি:
সখা-পরিবৃত হয়ে হুহু একদিন যখন সরোবরে স্নান করছিলেন, তখন সেই সরোবরে আবক্ষ জলে নেমে ঋষি দেবল ধ্যানমগ্ন হয়ে সূর্যের উপাসনা করছিলেন। তাই দেখে হুহুর দুর্বুদ্ধি জাগল ঋষিকে চমকে দিয়ে দারুণ রকমের তামাশা করার। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। তিনি জলের নীচে ডুবসাঁতার দিয়ে কুমীরের মতো দেবলের পা ধরে আচমকা টান দিলেন!
সেই হঠাৎ হ্যাঁচকা টানে দেবলের ধ্যান ভঙ্গ হল, উপাসনাও নষ্ট হয়ে গেল। ফলে, তিনি ভয়ানক ক্রুদ্ধ হয়ে হুহুকে নিদারুণ এক শাপ দিয়ে বসলেন। বললেন, যেভাবে কুমীরের ঢঙ ধরে হুহু ঋষির উপাসনা নষ্ট করলেন, সেই কুমীর-জন্ম নিয়েই হুহুকে আজীবন কাটাতে হবে।
শাপগ্রস্ত হুহু অচিরেই নিজের ভুল বুঝতে পেরে দেবলের পায়ে ধরে কাকুতি-মিনতি করলে দেবল দয়া করে দিলেন উদ্ধারের নিদান। বললেন, বিষ্ণুর হাতেই হবে হুহুর উদ্ধার। সেই নিদানেই গজরাজকে তিনি আক্রমণ করে বিষ্ণুর হাতে মৃত্যুবরণ করে মুক্তি পেলেন।
এভাবে কুমীর জন্ম থেকে মুক্ত হয়ে হুহু বিষ্ণুর চরণে প্রণিপাত করে ফিরে গেলেন গন্ধর্বলোকে।
হুহুর বৃত্তান্ত জেনে গজরাজের স্মরণ হল আপন অভিশাপের কাহিনি। তিনিও আপন ইষ্টের চরণে পরম ভক্তিভরে প্রণিপাত করে বললেন, হে প্রভু, গন্ধর্বরাজ হুহুকে তুমি যেমন অভিশাপ থেকে উদ্ধার করলে, আমাকেও এই শাপগ্রস্ত জীবন থেকে কৃপা করে উদ্ধার করো!
সত্যি বলতে কী, ভগবান বিষ্ণু গজরাজকে কৃপা করতেই এসেছিলেন। তার ওপর তাঁর এমন আত্ম-নিবেদনে তিনি আরও প্রসন্ন হলেন। গজরাজ ইষ্টের কৃপায় পুনরায় ইন্দ্রদ্যুম্নের রূপ ফিরে পেলেন। ঠাঁই পেলেন বিষ্ণুলোকে স্বয়ং বিষ্ণুর চরণে। তখন তারইষ্টের এই পরম কৃপায় ইন্দ্রদ্যুম্নের আনন্দের আর অন্ত রইল না।
ভগবান বিষ্ণুই জগন্নাথ, জগন্নাথই শ্রীবিষ্ণু। তাই বিষ্ণুর এই মোক্ষদায়ী কৃপার কথা স্মরণ করতেই শ্রীমন্দিরে মাঘী পূর্ণিমায় জগন্নাথের 'গজ-উদ্ধারণ বেশ' অনুষ্ঠিত হয়।
এই 'বেশ' ষোড়শ শতকে শ্রীমন্দিরে প্রথম অনুষ্ঠিত হয় ভম্য রাজবংশের রানি বকুল মহাদেবীর অভিলাষে। তারপর বেশ কিছুকাল কোন অজ্ঞাত কারণে এই বেশপ্রথা বন্ধ থাকে। ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে রাজা রামচন্দ্র দেব পুনরায় এই প্রথার প্রবর্তন করেন। বিগত কয়েক।দশক ধরে এই বেশের সমস্ত ব্যয় করতেন ওড়িশার বিশিষ্ট শিল্পপতি ইলা পণ্ডা। বর্তমানে তাঁর পরিবার বহন করেন।
গজ-উদ্ধারণ বেশ অনুষ্ঠিত হয় জগন্নাথের রাত্রিকালীন আহারগ্রহণ সমাধা হওয়ার পর, 'বড় শৃঙ্গার বেশ'-ধারণের কালে। ভিতরচু, তালিচু, পুষ্পালক, নিয়োগ ও মেকপ খুঁটিয়া প্রভৃতি সেবকের সমবেত প্রচেষ্টায় এই বেশকর্ম সম্পন্ন হয়।
এই বেশে ত্রিদেবদেবী ধারণ করেন মাথায় মুকুট, সূর্য-চন্দ্র, কানে কুণ্ডল, কটিতে অলঙ্কার, হাতে বালা, শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম, হল ও মুষল। এবং, সুভদ্রা ধারণ করেন তাঁর রত্নময় দুই বাহু।
এছাড়া, বেশকালে রত্নবেদির ঠিক সামনেই শোলা নির্মিত মূর্তিতে গজ-কুমীরের যুদ্ধ ফুটিয়ে তোলা হয়। স্থাপন করা হয় মোক্ষদায়ী গরুড়বাহন বিষ্ণুর ছলনমূর্তি। আর তাঁর কোলে স্থাপন করা হয় দেবী লক্ষ্মীকে। বছরের এই একটিমাত্র সাজবেশ, যেখানে লক্ষ্মী স্থান পান স্বয়ং বিষ্ণুর কোলে। ভক্তের বিশ্বাস এই বেশে জগন্নাথকে দর্শন করলেও অর্জিত সমস্ত পাপ নষ্ট হয়ে পাওয়া যায় মোক্ষের সন্ধান।
যাই হোক, মাঘ মাসের এই বিশিষ্ট ও মোক্ষদায়ী সাজবেশ দিয়েই আজকের পর্ব শেষ করছি। আগামি পর্বে নিয়ে আসব অন্যান্য সাজবেশের অনেক আকর্ষণীয় কাহিনি...