প্রাচীন মদন উৎসব থেকেই আজকের হোলি, দোল বা বসন্ত উৎসবের উদ্ভব। মদন উৎসবে কুমারী মেয়েরা মদনদেবের (কামদেবের) পূজা করত। তাদের বিশ্বাস ছিল যে, বসন্তকালে তাঁকে পূজা করলে শিবের মতো বর পাওয়া যাবে। কেন এই বিশ্বাস প্রচলিত হয়েছিল, তার পেছনে পৌরাণিক একটি কাহিনি আছে।
পৌরাণিক সেই কাহিনিতে রয়েছে যে, একদা দেবতারা তারকাসুরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তাকে বধ করার জন্য শিব ও পার্বতীর বিয়ে দিয়েছিলেন। কেননা, তারকাসুর বর পেয়েছিল যে, একমাত্র শিবের পুত্রের হাতেই তার মরণ হবে।
কিন্তু শিব-পার্বতীর বিয়ে দিয়েও দেবতাদের অভীষ্ট সিদ্ধ হল না। যোগী শিব সারাক্ষণ ধ্যানেই মগ্ন থাকেন, পার্বতীর সঙ্গে কিছুতেই মিলিত হওয়ার চিন্তা তাঁর মনে আর উদয় হয় না। মিলন না-হলে পুত্রের জন্ম হবে কী করে!
তখন দেবতারা পরামর্শ করে মদনদেব ও রতিকে ভার দিলেন শিবকে মিলন-ব্যাকুল করে তোলার জন্য। ব্রহ্মা সেই মিলনের উপযোগী প্রাকৃতিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে গিয়ে পুস্পসমৃদ্ধ ঋতু বসন্তের সৃজন করে ফেললেন। নবসৃষ্ট ঋতুতে মদনদেব ও রতি নৃত্য করতে করতে ধ্যানস্থ শিবের দিকে একদা কামবাণ ছুঁড়ে তাঁকে বিদ্ধ করলেন।
কামবাণে আহত হতেই অকালে শিবের ধ্যানভঙ্গ হল। আর এই অঘটনে ভীষণ রেগে গিয়ে অগ্নিদৃষ্টিতে শিব তৎক্ষণাৎ মদনদেবকে ভস্ম করে ফেললেন। কিন্তু কামবাণে আহত হওয়ায় মিলন ছাড়া তাঁর আর উপায় ছিল না। কাজেই তিনি পার্বতীর সঙ্গে মিলিত হলেন। তাতেই শিবপুত্র কার্তিকেয়র জন্ম হল। এবং কার্তিকেয়র হাতেই অচিরে তারকাসুর বধ সম্পন্ন হল। পরিশেষে এই ভাবে ত্রিলোক ও দেবতাদের মঙ্গল হল।
এবার বসন্তকালে ত্রিজগতের মঙ্গলের জন্য এই যে কামদেবের আত্মদান, সেই মহান ঘটনাকে স্মরণ করেই স্মরণাতীতকালের বসন্ত ঋতুতে প্রথমে মদন উৎসবের সূচনা হয়। তারপর জগতমঙ্গলের পাশাপাশি পার্বতী যে তাঁর জন্যই যোগী শিবকে কামনাসুন্দর প্রেমিক-স্বামীরূপে পেয়েছেন, এই বিষয়টাও বড় করে দেখা শুরু হয়। তখন কুমারী মেয়েরা শিব-সুন্দর স্বামী পাবার জন্য এই উৎসব উপলক্ষে মদনদেবের আলাদা করে বিশেষ পূজা করতে শুরু করে।
মহেন্দ্র দত্ত তাঁর ‘কলিকাতার পুরাতন কাহিনী ও প্রথা’ গন্থে লিখেছেন যে, ‘পুরাকালে বিবাহের পূর্বে মদনপূজা ছিল। বিবাহার্থী কন্যা নূতন বস্ত্র পরিয়া, মাঙ্গলিক দ্রব্য সঙ্গে লইয়া, সমবয়স্কা সখিগণ পরিবৃতা হইয়া, গ্রামের প্রান্তে এক প্রাচীন বৃক্ষতলে বা তরুগুল্ম মধ্যে মদনপূজা করিত। এই মদনপূজা করিলে অভীষ্টমত স্বামী পাইত।…কিন্তু পরিশেষে ব্যাপার হ’ল পিতা এক পাত্রের সহিত বিবাহ স্থির করেছেন, কন্যা কিন্তু গোপনে অপর এক যুবককে বিবাহ করিতে মনস্থ করিয়াছে। এই যুবক ঘোড়া করিয়া আসিয়া, দূরে ঘোড়া রাখিয়া, স্ত্রীলোকের কাপড় পরিয়া কন্যাদিগের সহিত মিলিত এবং মদনপূজা করিতে অল্পদূর স্থানে যাইতেছে এইরূপ স্থির করিয়া অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করিয়া উভয়ে পলায়ন করিত। কারণ এই সময় কন্যাদিগের সহিত কোন প্রাচীনা স্ত্রীলোক থাকতেন না। এইজন্য এই পূজা পরে বন্ধ হইয়া যায়।’
কুমারীদের মদনপূজা বন্ধ হবার বহু আগেই এই উৎসবে পূর্বোক্ত মঙ্গলময় দুই ঘটনা ঘটার শুভ কাল হিসেবে বসন্তকেও বিশেষ গুরুত্ব দিতে শুরু করেছিল মানুষ। বহুরঙা ফুলসাজে সজ্জিত শুভ ঋতুটির মতো হয়ে উঠতে চাইছিল। নিজেকে তারই মতো রঙিন করতে চাইছিল। শুরু করেছিল রঙের খেলা। বলা বাহুল্য, মদনপূজা বন্ধ হলে এই রঙের খেলাই ধীরে ধীরে মুখ্য হয়ে উঠেছিল। এই ধারাবিবরণীর ক্রম বিবর্তিত ছবিটি ধরা আছে আমাদের প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যের গ্রন্থরাজিতে। যেমনঃ
দ্বিতীয় শতকের নাট্যকার ভাসের ‘চারুদত্ত’ নাটকে মদনদেবের পট সামনে রেখে নারী-পুরুষ একত্রে রং-খেলার চিত্র পাওয়া যায়। সঙ্গীত ও নৃত্য ছিল এই খেলার অত্যাবশ্যক অঙ্গ।
দ্বিতীয় শতকের শেষদিকের নাট্যকার শূদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিকম’ নাটকেও প্রায় ওই একই ধরণের উৎসব উদযাপনের চিত্র পাওয়া যায়। জানা যায়, অন্যান্য নাগরিকের সঙ্গে সসম্মানে এই উৎসবে যোগ দিতেন গণিকারাও।
চতুর্থ শতকের কবি ও নাট্যকার কালিদাসের ‘কুমারসম্ভবম’ কাব্য থেকে জানা যায় যে, এই উৎসবের সময় অশোক গাছের নীচে কামদেবের পূজা করা হত। তিনি আবার ‘রত্নাবলী’ নাটকে জানিয়েছেন যে, উৎসবকালে অন্তঃপুরের পরিচারিকারা হাতে আমের মঞ্জরী নিয়ে নাচগান করত।
ষষ্ঠ শতকের গদ্যকাব্যরচয়িতা দণ্ডী তাঁর ‘দশকুমার চরিত’ গদ্যকাব্যে জানিয়েছেন যে, মদন উৎসবে বিশেষ এক মণ্ডপ তৈরি হত। সেখানে পাত্রমিত্র সহ উপবিষ্ট রাজা ও রানির সামনে মদন ও রতি সেজে নাচগান করতেন নটনটীরা।
অষ্টম শতকের কবি ও নাট্যকার ভবভূতির ‘মালতী মাধব’ নাটকে মদন উৎসবের এক মনোজ্ঞ বর্ণনা রয়েছে। তাতে বলা হয়েছে যে, উৎসবটি অনুষ্ঠিত হত মদনদেবের মন্দির প্রাঙ্গণে। সেখানে বহুবিধ সুগন্ধী ও সুদৃশ্য ফুলমালায় সুসজ্জিত অসংখ্য নারী-পুরুষ একত্রিত হত। তারপর তারা একে-অপরকে আবীর-কুঙ্কুমে রাঙাতে রাঙাতে গীত সহকারে নৃত্য করত। সব শেষে মদনদেবের মন্দিরে গিয়ে পুজো দিত। ওই অষ্টম শতকেরই শেষদিকের কবি দামোদর গুপ্তের ‘কুট্টনীমতম’ কাব্যে নগরনটীদের সঙ্গে মদন উৎসব যাপনের উল্লেখ আছে।
অষ্টম শতকেরই শেষদিকের আরেক কবি রাজশেখরের ‘কাব্যমীমাংসা’ ও দশম শতকের কবি ভোজরাজের ‘সরস্বতী কণ্ঠাভরণ’ কাব্য থেকে জানা যায় যে, অষ্টম শতক থেকেই মদন উৎসবে পিচকারী ব্যবহার করে রঙ ছড়ানো হত। পরস্পর পাঁক ছোঁড়াছুঁড়ি হত। এই উৎসব তখন বসন্ত পঞ্চমীতে শুরু হয়ে রঙখেলার মধ্য দিয়ে চলত ফাল্গুন পূর্ণিমা অব্দি।
দ্বাদশ শতকের কবি শ্রীহর্ষের ‘রত্নাবলী’ নাটকে মদনোৎসবের অপরূপ বিবরণ রয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে যে, নগরবাসী নরনারীরা উৎসব উদযাপন করতে গিয়ে এত কেশর আর কুঙ্কুম ছড়াতেন যে, নগরের পথঘাট সমস্তই রঙিন হয়ে উঠত।
ষোড়শ শতকের কবি গোবিন্দানন্দ বিরচিত ‘বর্ষক্রিয়া কৌমুদী’ কাব্যে জানা যায় যে, এই উৎসবে সারাদিন গান-বাজনা করে একে-অপরের দিকে পাঁক ছোঁড়াছুঁড়ি করে আনন্দ উদযাপন করা হত। বিকেলে স্নান করে ভালো জামাকাপড় পরে সুসজ্জিত হয়ে বয়স্যদের সঙ্গে আড্ডায় মাতা হত।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, ইতিহাসের দীর্ঘপথে বহু পরিক্রমা পেরিয়ে রূপান্তরের বহুস্তর বেয়ে মদন উৎসব থেকে আজকের দোল বা হোলি উৎসবের রঙিন অবয়বটি গড়ে উঠেছে। রঙের আদর, প্রেমের আকর আর রাঙানোর আবদার নিয়ে ঘিরে রয়েছে আমাদের; এগিয়ে চলেছে আবহমান সংস্কৃতির অচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে…