ইতিহাস ও মিথের মেলবন্ধন কপালকুণ্ডলা মন্দির

বঙ্গে মিথ থেকে দেব দেবীর সৃষ্টি হয়েছে। গড়ে উঠেছে মন্দির। তেমনই মিথ থেকে তৈরি হওয়া মন্দিরের অন্যতম হল কপালকুণ্ডলা মন্দির। সাহিত্যের মানবী কপালকুণ্ডলার নামে একটি মন্দিরের নাম কপালকুণ্ডলা মন্দির। কাঁথি মহাকুমার দেশপ্রাণ ব্লকের দরিয়াপুর গ্রাম। এই গ্রামেই রয়েছে কপালকুণ্ডলা মন্দির। বঙ্গোপসাগরের খুব কাছের রসুলপুর নদীর দক্ষিণ দিকে অবস্থিত দরিয়াপুর গ্রাম। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের পটভূমি এই দরিয়াপুর ও পার্শ্ববর্তী দৌলতপুর গ্রাম। ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার আগে, জনপ্রিয়তা লাভ করার আগে,  কপালকুণ্ডলা নামে কোনও মন্দিরের অস্তিত্ব ছিল না। বর্তমানে যে মন্দিরটি কপালকুণ্ডলা মন্দির নামে জনপ্রিয় তা পড়িয়ারি পরিবারের দেবী ভৈরবী দেবীর মন্দির। বয়সে অতিপ্রাচীন এই মন্দির। পূর্ব মেদিনীপুরের রসুলপুর নদী, তার একপাশে হিজলি ও নিজকসবা গ্রাম আর অন্য পাশে দারিয়াপুর ও দৌলতপুর। ইতিহাস বর্ধিষ্ণু গ্রাম। সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'কপালকুণ্ডলা' উপন্যাসের কাহিনিতে অক্ষয় হয়ে থেকে গিয়েছে এই গ্রামগুলির নাম।

১৮৫৮-৫৯ সালে কাঁথির তৎকালীন নেগুঁয়া সাব ডিভিশনাল অফিসার হয়ে আসেন বঙ্কিমচন্দ্র। তখনও তিনি সাহিত্যের সম্রাট নন, ব্রিটিশ সরকারের অধীনস্থ একজন চাকুরে। মোকদ্দমার সূত্রে বেশ কিছুদিন তাঁকে থাকতে হয় দৌলতপুর গ্রামে। তখনই জন্ম নেয় 'কপালকুণ্ডলা'র কাহিনি। হিজলি গ্রামের প্রাকৃতিক শোভা তাঁকে মুগ্ধ করে। প্রাচীন বন্দরের ভগ্নস্তুপের উপর দাঁড়িয়ে তিনি নিজের মনের কথাই বসিয়ে দেন নবকুমারের মুখে। "আহা! কি দেখলাম! জন্ম জন্মান্তরে ভুলিব না।" সেই সুদর্শন জলরাশির ধারেই আবার দেখলেন নিবিড় নিশ্ছিদ্র অরণ্য। অরণ্যের ভিতর যেন কেউ বলে উঠল, "পথিক, তুমি পথ হারাইছ?" শুরু হল উপন্যাসের কাহিনি।

তবে হিজলির ইতিহাস আরও পুরনো। খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতকের পূর্বে এই অঞ্চলে রাজত্ব করতেন উড়িষ্যার গজপতি রাজারা। ১৬২৮ সালে কেলেঘাই আর রশুলপুর নদীকে খাল কেটে যুক্ত করা হয়। তৈরি হয় হিজলি বন্দর। সেই বন্দরকে ঘিরেই গড়ে ওঠে হিজলি রাজ্য। বন্দরে ব্যবসা বাড়তে থাকে, রাজ্যের অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধি হয়। দিল্লির সুলতানদের নজরে পড়ে এই রাজ্য। সম্রাট শাজাহানের কাছ থেকে ২৮টি মহল মনসব নিয়ে হিজলির প্রথম ফৌজদার হয়ে আসেন তাজ খাঁ। তাঁর নির্মিত মসজিদ এবং পীরের মাজার এখনও অক্ষত।

এর কিছু কাল পর আসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ১৬৭৯ সালে প্রথম ব্রিটিশ জাহাজ 'ফরণ' এসে থামে হিজলি বন্দরে। কিন্তু বন্দরের দখল নিতে পারে না। ১৬৮৬-৮৭ সালে কিছু সময়ের জন্য বন্দরের দখল নিতে পেরেছিলেন জব চার্ণক। কিন্তু আবার তা চলে যায় মোঘল শাসকদের হাতে। জব চার্ণক তখনও কলিকাতা এসে পৌঁছোননি। এই হিজলি গ্রামেই ব্রিটিশ সরকার তৈরি করেছিল ডিটেনশন ক্যাম্প। ১৯৩১ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর সেখানে গুলি করে মারা হয় সন্তোষ কুমার মিত্র ও তারকেশ্বর সেনগুপ্ত নামে দুই স্বাধীনতা সংগ্রামীকে।

তবে এই সমস্ত ইতিহাসের পাশাপাশি, হিজলি গ্রামের কথা মনে করিয়ে দেয় একটি মিথ। কপালকুণ্ডলার মন্দির। যদিও বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের তান্ত্রিকের কোন মন্দির ছিল না। তিনি বালির স্তূপের উপর বসে সাধনা করতেন। কিন্তু গ্রামে গেলেই গ্রামবাসী আপনাকে দেখিয়ে দেবে সেই কিংবদন্তি কালীমন্দির। এমনকি যে মন্দিরে কপালকুণ্ডলা ও নবকুমারের বিবাহ হয়েছিল, এটি সেই মন্দিরও নয়।

"পথিক, তুমি পথ হারাইছ? আইস।" উপন্যাস শুরু। বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলা উপন্যাসে নবকুমার সুরেলা মেয়ে কন্ঠে চমকে গিয়েছিল। কাপালিক পালিতা কন্যা কপালকুণ্ডলা নবকুমার কে কাপালিকের হাত থেকে বাঁচিয়ে পালিয়ে যাওয়ার পথ দেখিয়ে দেয়। বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের কাহিনীর পটভূমি কাঁথির দরিয়াপুর। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে কাঁথির ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে যোগদান করেন। এখানে ছিলেন মাত্র ৯ মাস। কাঁথির তখন হেড অফিস ছিল নেগুয়া অঞ্চলে। একটি ডাকাতির মামলায় দরিয়াপুরে আসেন বঙ্কিমচন্দ্র। সেইসময় তিনি এই উপন্যাস লেখেন বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের কাপালিক বালিয়াড়ির ওপর তন্ত্র সাধনা করতেন। সাধনার সিধিলাভের উদ্দেশে নবকুমারকে বলি দেওয়ার জন্য বেঁধে রাখেন। কপালকুণ্ডলা বলি দেওয়ার খড়্গ দিয়েই কেটে দেয় নবকুমারের বাঁধন খুলে দেয় এবং পালিয়ে যাওয়ার রাস্তা দেখিয়ে দেয়। তন্ত্রসাধনার জন্য কোন মন্দির ছিল না। তাহলে মন্দির হল কী করে?

১৮৬৬ সালে কপালকুণ্ডলা উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার পরেই দরিয়াপুরের একটি মন্দির কপালকুণ্ডলা মন্দির নামে পরিচিত পায়। প্রাচীন এই মন্দির বর্তমানে হেরিটেজের মর্যাদা পেয়েছে। মন্দির কে সম্পূর্ণরূপে সংস্কার করা হয়েছে। পড়িয়ারি পরিবারের বর্তমান ১৯ তম বংশধরেরা বংশপরম্পরায় মন্দিরের অধিষ্ঠিত ভৈরবী দেবীর সেবায়েত হিসেবে পুজো করে আসছেন। ভৈরবী দেবীর মন্দির পাশেই রয়েছে একটি খড়্গ। কথিত আছে এই খড়্গ দিয়েই কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের কাপালিক নবকুমারকে বলি দিতে চেয়েছিল। কোথাও যেন সাহিত্য ও ইতিহাস পাশাপাশি অবস্থান করে আছে। আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষকদের কথায় এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কাঁথির কিশোর নগর গড় রাজবাড়ির রাজা যাদব রামরায়। কেউ কেউ আবার বলেন রাজা যাদবরাম রায় মন্দির সংস্কার করেছিলেন মাত্র। মন্দির তারও আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তাই এই মন্দিরে আনুমানিক বয়স কত তা সঠিক বলা যায় না। আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষকদের মতে, এখানে ভৈরবী চণ্ডী মন্দির ছিল। দেবী চণ্ডী রূপে পূজিত হত। কিন্তু সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কপালকুণ্ডলা উপন্যাস জনপ্রিয়তা লাভ করায় এই মন্দির কপালকুণ্ডলা নামে পরিচিত হয়। দেবী ভৈরবী কালী রূপে পূজিত হতে শুরু হয়।

কপালকুণ্ডলার স্মৃতিতে গ্রামবাসীরা এতটাই বিভোর যে, পুরানো মন্দির থেকে কিছুটা দূরে কাঁথি-পেটুয়াঘাট রাস্তার পাশে আরও একটি কালীমন্দির গড়ে তুলেছেন তাঁরা। গ্রামের বাসিন্দারা মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ করেন। কালীপুজোর সময় পুজো হয় এই নতুন কপালকুণ্ডলা মন্দিরে। প্রায় চার বছর আগে সংস্কার হয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠা পায়নি কালীমূর্তি। যে কারণে নতুনভাবে সেজে ওঠার পরও ঝোপের আড়ালে মুখ লুকিয়েছে কাঁথি দেশপ্রাণ ব্লকের দারিয়াপুর গ্রামের ঐতিহাসিক কপালকুণ্ডলা মন্দির। তারপর থেকে মন্দিরটি ফাঁকাই পড়ে রয়েছে। অনেকে মন্দির দর্শনে এসে তাতে কোনও প্রতিমা না দেখে বিস্মিতও হন। কালীপুজোর সময় বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলা মন্দির ছেড়ে গ্রামবাসীরা সামনে থাকা কপালকুণ্ডলা মন্দিরে মা কালীর আরাধনায় মেতে ওঠেন। সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মানসকন্যা কপালকুণ্ডলা নামাঙ্কিত এই মন্দিরটি দীর্ঘকাল জীর্ণ, ভগ্নপ্রায় অবস্থায় ছিল। তবে এই মন্দিরে আগে কালীপুজো হত কিনা, তা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক রয়েছে। কারণ বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলা উপন্যাসে কালীমূর্তির কথা বলা হলেও এখানে কোনও বিগ্রহ ছিল কিনা তা জানা নেই অনেকের। এলাকার বাসিন্দাদের দাবি মন্দিরে কালীপ্রতিমা প্রতিষ্ঠা করে নিয়মিত পুজোর ব্যবস্থা হোক। মিথ এসব ইতিহাসের পরোয়া করে না। ঘটনার ঘনঘটা মিশে রয়েছে মেদিনীপুরের ঐতিহাসিক এই মন্দিরে।  

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...