জনমানুষহীন জঙ্গলের মধ্যে মাটি ঢাকা এক কৃষ্ণ শিলা হঠাৎ দেখলে বিশেষ বোঝা যায় না। কিন্তু রাখালরা যখন গোরু চরাতে যায়, দেখে সেই শিলার কাছে দাঁড়িয়ে পড়ে গাভী। দুধ চুঁইয়ে পড়ে তার গায়ে।সেই অদ্ভুত দৃশ্যের কাহিনি ছড়িয়ে পড়ে তাদের গ্রামে। জানা যায় ‘কালোপাথরে’র কথা।
লোককথা অনুযায়ী, রাজা বিষ্ণুদাস নামে এক রাজার এক গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী ভাই ভারমল্ল, ঘুরতে ঘুরতে গুড়ে-ভাটা নামে গ্রামে আসেন। এখানে রাজার গোরক্ষকের কাছে জানতে পারেন যে, কিছু গাভী জঙ্গলে প্রবেশ করে একটি শিলার উপর দুগ্ধ দান করে।
ভারমল্ল সেই আশ্চর্য কথা রাজা বিষ্ণুদাসকে জানায়। তখন রাজা ওই শিলাখণ্ডটি নিজ ভূম রামনগরে আনার উদ্যোগ নেন। শিলাটিকে তুলে আনার জন্য রাজার লোকেরা প্রথম দিন পঞ্চাশ হাত খনন করার পরও এর ভিত্তি খুঁজে না পেয়ে, সেদিনের মতো কাজ বন্ধ রাখেন। সে রাত্রে বিষ্ণুদাসকে মহাদেব স্বপ্নে জানান যে, তিনি তারকেশ্বর শিব। তাঁর প্রসার গয়া গঙ্গা কাশী পর্যন্ত। সুতরাং খনন করে তাঁকে তোলা যাবে না। স্বপ্নে এই স্থানে মন্দির নির্মাণ করে, তার নাম যেন 'তারকেশ্বর মন্দির' নামে অভিহিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এইভাবেই জন্ম হয় তারকনাথ মন্দিরের।
স্বপ্নদর্শনের পর রাজা ১১৩৬ বঙ্গাব্দে ওই শিলার উপরে একটি আটচালা ছাউনি দিয়ে মন্দির গড়ে তোলেন। তখন থেকেই তারেকশ্বর বঙ্গবাসীর কাছে পরম আরাধ্য দেবতায় পরিণত হয়।
রাজা মন্দিরের ব্যয়ভার নির্বাহের জন্য ১০২৩ বিঘা জমি দান করেন। আদি মন্দিরটি ভেঙে গেলে বর্ধমানের রাজা এর সংস্কার করেন। পরে পাতুল-সন্ধিপুর অঞ্চলের গোবর্ধন রক্ষিত এর আবার মন্দিরের সংস্কার করেন। ১২০৮ বঙ্গাব্দে বালিগড়ের রাজা চিন্তামণি দে এই মন্দিরে প্রার্থনা করে আরোগ্য লাভ করার পর, মন্দিরের সামনে নাটমন্দির তৈরি করে দেন।
রাজা বিষ্ণুদাস জৌনপুরের ডোভি পরগণার গোমতী নদীর তীরের ভূখন্ড হরিপুরের রাজা ছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে তাঁর সঙ্গে কাশীর রাজা বলবন্ত সিংহের সংঘর্ষ হয়। প্রায় ৫০০ অনুচর সমেত বিষ্ণুদাস হুগলি অঞ্চলে চলে আসেন। হুগলি তখন জঙ্গলে ঢাকা। হরিপালের রামনগর তিনি নতুন বসতি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। এই সময় বাংলার নবাব মুর্শিদকুলী খানের অনুমতি নিয়ে তিনি জমিদারির পত্তন করেন। মুর্শিদকুলী খান তাঁর জমিদারী জন্য প্রাথমিকভাবে পাঁচশত বিঘা জমি দান করেছিলেন।
আজকের আটচালা মন্দিরটি তৈরি করেন শিয়াখালার গোবর্ধন রক্ষিত। স্বয়ম্ভু শিবলিঙ্গ ছাড়াও মন্দিরে রয়েছেন বাসুদেব, ব্রহ্মা। শিবরাত্রি ও চৈত্র সংক্রান্তিতে আর শ্রাবণ মাসের প্রতি সোমবারে অসংখ্য ভক্ত সমাগম হয়। মন্দিরের লাগোয়া দুধপুকুর। সংস্কারের পর দুধপুকুর এখন পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর। এই পুকুরে স্নান করলে পুণ্য হয় বলে লোকের বিশ্বাস।
পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত শিবতীর্থগুলির মধ্যে অন্যতম প্রধান কেন্দ্র তারকেশ্বর। বৈশাখ-শ্রাবণ মাসে ভক্তদের ভিড়ে তিলধারণের স্থান থাকে না মন্দির চত্বরে।
করোনা বিধিতে মন্দির কিছুকাল যাবৎ বন্ধ থাকার পর আবার তারকেশ্বর মন্দির ফিরেছে তার চেনা ছন্দে।
কলকাতার থেকে ৫৮ কিলোমিটার দূরে তারকেশ্বরের অবস্থান। হাওড়া থেকে ট্রেনে পৌঁছে যাওয়া যায় তারকেশ্বরে। বাসেও যাওয়া যায়। বহু ভক্ত কলকাতা-হাওড়ায় গঙ্গা থেকে বা বৈদ্যবাটির নিমাইতীর্থ ঘাট থেকে বাঁকে জল নিয়ে পায়ে হেঁটে তারকেশ্বর তীর্থ দর্শন করেন।