৭৮-এর বন্যায় বস্তিবাসী ও গৃহহীন মানুষদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল এই বনেদি বাড়িতে

মুঘল আমলে এক পঞ্জাবি ব্যবসায়ী পুরী তীর্থ ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। ঘুরতে ঘুরতে তিনি এসে পড়েন বর্ধমানে। বর্ধমানের কাছে বৈকন্ঠপুরে বসবাস করার সময় সেই জায়গাটি তাঁর অত্যন্ত ভালো লেগে গিয়েছিল। তাঁর নাম ছিল সঙ্গম রাই। তিনি বৈকন্ঠপুরেই বসবাস করার সিদ্ধান্ত নেন। শুধু বসবাস করা নয়, জমিয়ে ব্যবসা করা শুরু করেছিলেন। তিনি নানা পণ্য সামগ্রী একটা ক্যারাভ্যানে করে নিয়ে সেইসব ব্যবসা করতেন। পরবর্তীকালে বৈকন্ঠপুরে একটি হাট বসান তিনি। তার সাময়িক যাযাবর জীবন সেখানেই শেষ হয়। কিন্তু এখান থেকে শুরু হয় এক নতুন জীবনের জয়যাত্রা। পরবর্তীকালে তিনি বর্ধমানে গড়ে তোলেন একটি প্রাসাদ। তাঁর বংশধরেরা ধীরে ধীরে বর্ধমানের মহারাজাধিরাজ হয়ে ওঠেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রাসাদ, ধন-সম্পত্তি তৈরি করেন। বর্ধমান রাজবাড়ি এই পরিবারের তৈরি প্রাসাদ। বর্ধমানের এই রাজ পরিবারের গড়ে তোলা একটি প্রাসাদ ১০ নম্বর এ ডায়মন্ড হারবার রোডের বিজয়মঞ্জিল। বর্ধমান রাজাদের তৈরি একটি বনদী বাড়ি। শুধুমাত্র বর্ধমান রাজ পরিবারের কথা নয় এই বাড়িতে সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ভারতের অন্যান্য প্রান্তের নানা ইতিহাসের কথা।

 

ব্যবসার দিক থেকে এই সঙ্গম রাইয়ের পরিবার পরবর্তীকালে একটা বিশেষ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। বর্ধমানের রাজ পরিবার কলকাতায় তাঁদের ব্যবসা ছড়িয়ে দেন। এই পরিবারের তরফে মুঘলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করা হয়েছিল। এই পরিবারের এক রানী বিষ্ণুকুমারী ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে এগিয়ে গিয়ে লড়াই করেছিলেন। রানীর উপর দিকে গিয়ে ব্রিটিশরা তাঁর সন্তান তেজ চন্দ্রের বিরুদ্ধে অপশাসনের অভিযোগ এনে তাঁকে গৃহবন্দী করে রেখেছিলেন। নিজের সন্তানকেও দেশপ্রেমের শিক্ষায় শিক্ষিত করেছিলেন বর্ধমান রাজ পরিবারের এই রানী।

 

তবে বিচ্ছিন্ন কয়েকটি ঘটনা ছাড়া বর্ধমানের রাজ পরিবারের সঙ্গে ব্রিটিশদের সম্পর্ক খারাপ ছিল না। এই পরিবারের অনেকেই ব্রিটিশ সরকারের কাছে কাজ করেছেন।

 

মূলত ব্রিটিশদের সঙ্গে কাজ কর্মের জন্য এবং রাজকীয় কিছু আচার অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার কারণে এই রাজপরিবারকে কলকাতায় একটি অল্টারনেটিভ বাসস্থান অর্থাৎ বিজয়মঞ্জিল তৈরি করতে হয়েছিল। প্রথমদিকে ব্যবসা-বাণিজ্যের খাতিরে এঁরা বর্ধমানেই নিজেদের প্রতিপত্তি বাড়ানোর দিকে অগ্রসর হয়েছিলেন। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এঁরা বুঝতে পারেন, কলকাতার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন না করতে পারলে ব্যবসা এগুলো যাবেনা। বর্ধমান বা কলকাতা ছাড়াও তাঁদের প্রাসাদ ছিল কাশী, ভাগলপুর, দার্জিলিং, কার্শিয়াং, পাংখাবাড়ি, চুঁচুড়ার মতো জায়গাতেও। বর্ধমান থেকে মহারাজারা ট্রেনে করে ভাগলপুর যেতেন। সেখান থেকে ঘোড়ার গাড়িতে শিলিগুড়ি। শিলিগুড়ি থেকে টাট্টু ঘোড়ায় চেপে পৌঁছে যেতেন পাংখাবাড়ি। তারপর কার্শিয়াং-দার্জিলিং। তাঁদের নিজস্ব একটি স্টিমার ছিল। তার নাম ছিল মহতাব। স্টিমার বাঁধা থাকতো চুঁচুড়ার ঘাটে। এভাবে সারা পশ্চিমবঙ্গ ঘুরে এই ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অন্যান্য কাজ সারতেন বর্ধমানের রাজ পরিবারের মানুষজন। কিন্তু ব্যবসার শ্রীবৃদ্ধির সঙ্গে তাঁরা বুঝতে পারলেন, এভাবে সম্ভব নয়, কলকাতায় তৈরি করলেন বিজয় মঞ্জিল।

 

বর্ধমানের মহারাজা আফতাবচাঁদের আমলে ১৮৮৩ সালে আরাতুন আখতাবের কাছ থেকে বিজয় মঞ্জিলের জন্য জমি কেনা হয়।। পরে ১৮৯১ সালে মহারাজা বিজয়চাঁদের আমলে ললিতমোহন বসাক ও মোহন বসাকের কাছ থেকে আগের জমির সংলগ্ন আরো কয়েক বিঘা জমি কেনা হয়েছিল। মোট ৮০ বিঘা জমির উপর বাগান ও পুকুর নিয়ে বাড়িটি তৈরি করিয়েছিলেন বর্ধমান রাজ পরিবারের সন্তান বিজয়চাঁদ। নিজের নামে বাড়ি তৈরি করিয়েছিলেন তিনি। মার্টিন বার্ন এন্ড কোম্পানি তৈরি করেন বাড়িটি।

 

দোতলা বাড়ি। নিচের তলায় দুটি অংশ। একটি অংশকে ব্যাচেলর স্যুট নামকরণ করা হয়েছিল। রাজপরিবারের অবিবাহিতরা এখানে থাকতেন। তাঁদের ড্রেসিংরুম, বেডরুম সিটিং রুম আলাদা করা ছিল। দুটি অংশের মাঝে ব্যাংকোয়েট হল আর বিলিয়র্ডস রুম ছিল। পিলার দিয়ে দুটি ঘর আলাদা করা হয়েছিল। ঘর দুটির ঠিক ওপরে দোতলায় রিসেপশন হল রয়েছে। কাঠের মেঝে, ফলস সিলিং, একেবারে আধুনিক কায়দায় তৈরি বাড়ি। এই ঘরের সমস্ত আসবাব এবং তৈজসপত্র চীনা শিল্পের উৎকর্ষ নিদর্শন। কাঠের অসাধারণ কারুকার্য করা রয়েছে তাতে। দেওয়াল থেকে ঝুলন্ত কাট ক্লাসের বাতিগুলিকে ধরে আছে কাঠের তৈরি সুন্দর ফুল এবং লতাপাতা।

 

বাড়ির দক্ষিণ খোলা বারান্দা লন এবং পুকুর। পুকুরের পূর্ব দিকে রয়েছে শিব মন্দির। সমস্ত বাড়িতেই সদর ও অন্দর এই দুই মহলে বিভক্ত। অন্দরমহলের প্রথম ঘরটিতেই থাকতেন মহারানী। পাশেই তাঁর বসার ঘর। জনশ্রুতি যে তাঁর অনুমতি ছাড়া অন্দরমহলে কেউ প্রবেশ করতে পারতেন না। একটি লেডিস সিটিং রুমে অপেক্ষা করতে হতো সকলকে।

 

একসময় প্রায় ২০০ কর্মচারী এই বাড়িতে কাজ করতেন। মহারাজা  উদয়চাঁদ কলকাতায় এলে এখানে রাজ দরবার বসানো হত। মহারাজার আসার সংবাদ দেওয়ার জন্য বাড়ির মাথায় উড়িয়ে দেওয়া হত রাজপতাকা। তিনি অন্যত্র চলে গেলে রাজপতাকা নামিয়ে নেওয়া হত। জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর মহারাজা উদয়চাঁদ এই বাড়িতে বসবাস করতেন। এই বাড়িতে এখনো রাজ পরিবারের উত্তরসূরীরা বাস করেন।

 

ব্যবসা-বাণিজ্যে বিরাট উন্নতি, ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে হৃদ্যতা, বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্ষমতাবানদের সঙ্গে থাকা এবং আর্থিক উন্নতির ক্ষেত্রে চরমসীমায় পৌঁছনোর পরেও বর্ধমানের রাজ পরিবারের মানুষরা হৃদয়হীন ছিলেন না। ১৯৭৮ সালে কলকাতার বৃষ্টি-বন্যায় অনেক বস্তিবাসী ও গৃহহীন মানুষকে আশ্রয় দিয়েছিল এই বিজয় মঞ্জিল। তৎকালীন মহারাজা দোতলার একটি নির্দিষ্ট কামরা খুলে দিয়েছিলেন গৃহহীন মানুষদের জন্য। এছাড়াও ব্যাংকোয়েট হলেও থাকতে দেওয়া হয়েছিল বহু নিরাশ্রয় মানুষকে।

 

নেপালের রাজনৈতিক সংকটের সময় পারিবারিক বন্ধু হিসেবে এ বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন নেপালের তৎকালীন রাজা ত্রিভুবন নারায়ণের পুত্র মহেন্দ্র নারায়ণ। ডায়মন্ডহারবার রোডের জটিল বড় বড় বাড়ির আড়ালে বিজয় মঞ্জিলকে খুঁজে পেতে বেশ কষ্টই করতে হয়। কিন্তু এই বাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বিভিন্ন ঘটনাবলী, ইতিহাস এই বাড়িকে কলকাতার ইতিহাসের বুকে একটি অনন্য স্থাপত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।



তথ‍্যসূত্রঃ- বনেদী কলকাতার ঘরবাড়িঃ- দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় 

ক‍্যালকাটা থেকে কলকাতাঃ- গৌতম বসুমল্লিক

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...