জন্মাষ্টমীতে কোন কোন কৃষ্ণতীর্থ ভক্তদের অবশ্য গন্তব্য

জন্মাষ্টমী উপলক্ষ্যে মেতে ওঠে গোটা দেশ। দেশের নানাপ্রান্তে ছড়িয়ে থাকা কৃষ্ণমন্দির এবং তীর্থস্থানে জমায়েত ঘটে ভক্তদের।  বিশেষ কর উত্তরপ্রদেশে অবস্থিত কৃষ্ণ তীর্থগুলিতে। জন্মাষ্টমীতে কোন কোন কৃষ্ণতীর্থ কৃষ্ণভক্তদের অবশ্য গন্তব্য তার সন্ধান রইল এই নিবন্ধে 

মথুরা-  যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত মথুরা নগরী কৃষ্ণের জন্মস্থান। এই নগরীতেই কংসের কারাগারে জন্মগ্ৰহণ করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। জন্মাষ্টমী উপলক্ষে, এখানকার শ্রীকৃষ্ণ জন্মভূমি মন্দিরে প্রধান বিশাল এক উৎসবের আয়োজন করা হয়। প্রায় এক মাস ধরে এই উৎসব পালনের প্রস্তুতি নেওয়া হয় এবং শ্রীকৃষ্ণের পোশাকের রঙ আর মন্দিরের রঙ রাখা হয় এক। এছাড়াও ভগবানকে পঞ্চামৃত ও ৫৬ ভোগ দেওয়া হয়। পরে এই ভোগ ভক্তদের মধ্যে বিতরণ করে‌ দেওয়া হয়। প্রতি বছর প্রায় ৮ লক্ষ ভক্ত মথুরায় এই ঐশ্বরিক উৎসবে সামিল হন। মথুরায় প্রায় ৪০০ কৃষ্ণমন্দির আছে। উত্তরপ্রদেশে রাজধানী লখনউ থেকে দূরত্ব মাত্র ৪২৪ কিলোমিটার।

বৃন্দাবন- সংস্কৃত ভাষায় ‘বৃন্দা’ মানে তুলসী, আর ‘বন’ অরণ্য। অনুমান তুলসী বনের আধিক্য থেকেই এই ভূমির নাম হয় বৃন্দাবন। যমুনার তীরে প্রাচীন লোকভূমি এখন পুরোদস্তুর শহর। হিন্দুদের অবশ্যগামী তীর্থ। প্রায় ৫ হাজারেরও বেশি মন্দির আছে বৃন্দাবননগরীতে। সারাবছর কৃষ্ণপ্রেমী মানুষের ভিড়ে ভরে থাকে। জন্মাষ্টমীর নির্ধারিত দিনের ৮-১০ দিন আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় উৎসব। বিশ্বের নানাপ্রান্ত থেকে ভক্তরা আসে। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী ৫ হাজার বছর আগে বৃন্দাবনের মধুবনে গোপীদের সঙ্গে রাসলীলা রচনা করেছিলেন গোপিকাকান্ত। শোনা আজও তিনি ফিরে আসেন মধুবনে। জন্মাষ্টমীতে বিশেষ উৎসব হয় এই মন্দিরে।

গোকুল- গোকুল মথুরা থেকে দশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত, একটি সুপরিচিত হিন্দু তীর্থস্থান। ভাগবত পুরাণ অনুসারে , গোকুল কৃষ্ণের তাঁর শৈশবের লীলাভূমি। এখানেই পিতা নন্দ আর মা যশোদার আদরে কৃষ্ণ যৌবনপ্রাপ্ত হন। গোকুলে শ্রী ঠাকুরানীর ঘাট, নন্দ ভবন, রামনাস রেতি, ব্রহ্মাণ্ড ঘট, গোকুলনাথ মন্দির দর্শন করেন ভক্তরা।

গোকুলনাথ মন্দির- গোকুলনাথ মন্দির গোকুলের একটি অত্যন্ত পবিত্র স্থান। বিশেষ করে কৃষ্ণ জন্মাষ্টমী এবং অন্নকুট উৎসবের সময় হাজার হাজার তীর্থযাত্রী এই মন্দির পরিদর্শনে আসেন।

গোবর্ধন ধাম- মথুরা থেকে ২৩ কিমি দূরে অবস্থিত গোবর্ধন ধামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বালক কৃষ্ণের লীলা কাহিনি। গোবর্ধন গিরিকে বলা হয় গিরিরাজ। গোবর্ধন গিরির গোবর্ধন শিলাকে কৃষ্ণের প্রাকৃতিক রূপ হিসাবে মানেন ভক্তরা।  চৈতন্য মহাপ্রভু যখন ১৫১৫ খ্রিস্টাব্দে বৃন্দাবন পরিদর্শনের সময় গোবর্ধন পাহাড়ের পরিক্রমা (প্রদক্ষিণ) করেছিলেন, তখন তিনি পাহাড়ে হাঁটেননি কারণ তিনি গোবর্ধনকে শ্রীকৃষ্ণের থেকে আলাদা বলে মনে করতেন না । ঐতিহ্যগতভাবে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মানুষ গোবর্ধন গিরিতে পা রাখেন না। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, হাজার হাজার বছর আগে, দেবতা ইন্দ্রের ক্রোধ থেকে ব্রজবাসীকে রক্ষা করার জন্য, কৃষ্ণ গোবর্ধন গিরি তুলেছিলেন এবং তাঁর আঙুল দিয়ে তাঁর মাথার উপরে ধরে রাখেন। সেই কারণে কৃষ্ণকে গোবর্ধনধারী বলা হয়। বল্লভাচার্য ঐতিহ্যের অনুসারীরা, ভগবান কৃষ্ণের ভক্ত, গোবর্ধন শিলার উপাসনা করেন।  

বাঁকেবিহারী মন্দির- বৃন্দাবনের রহস্যময় মন্দির নিধিবন। বলা হয় প্রতি রাতে কৃষ্ণ ফিরে আসেন এই মন্দিরে। এখানেই রাধা আর গোপীদের সঙ্গে রাসলীলা সাধন করেন। এই মন্দির বন তুলসি গাছে ঢাকা। ভক্ত হরিদাস স্বামী কৃষ্ণ প্রেমে মগ্ন হয়ে থাকতেন। তাঁকে এই স্থানেই দেখা দিয়েছিলেন শ্রীরাধা আর কৃষ্ণ। পরে তাঁরা একই অঙ্গে লীন হয়ে বাঁকে-বিহারী রূপ নিয়ে প্রিয় ভক্ত হরিদাস ঠাকুরের সঙ্গে রয়ে যান। পরবর্তী সম য়ে নিধিবনে মন্দির গড়ে উঠলে তাঁদের আলাদা আলদা রূপে স্থাপন করা হয়।  মন্দিরে ভিতরে রঙমহল। সন্ধ্যা আরতির পর মন্দিরের সেবায়ত এবং পুরোহিতরা সেখানে প্রতিদিন নিম ডাল, শাড়ি, চুড়ি, পান পাতা, মিষ্টি, জলপাত্র রেখে আসেন। সকালে দ্বার খোলার পর দেখে মনে হয় সেসব কেউ ব্যবহার করেছে। চন্দন কাঠে তৈরি শয্যাও আছে রঙমহলে। 

নিধিবন- সন্ধ্যা আরতির পর মন্দির চত্বরে আর কারুর থাকার অনুমতি নেই। এমনকি বাঁদর বা কুকুর পর্যন্ত দেখা যায় না। মন্দিরের সমস্ত জানলা বন্ধ করে দেওয়া হয়। স্থানীয় মানুষরাও এই পথ এড়িয়ে চলেন। কেউ কেউ নাকি রাতে নূপুরের আওয়াজও পেয়েছে। বাঁকে বিহারির মন্দির নিয়ে আরও একটি কাহিনি শোনা যায়। এই মন্দির গড়ে উঠেছে রুক্ষভূমিতে। কিন্তু এই চত্বর জঙ্গল বনরাজিতে ঘেরা। তবে আশ্চর্যজনক ভাবে  আশেপাশের গাছের শাখা সবই নিম্নমুখী। মানুষের বিশ্বাস কৃষ্ণপ্রেমেই গাছের শাখা-প্রশাখা নতমুখী। এই গাছগুলোই গোপীনিতে পরিবর্তিত হয়ে যায় পরে।

দ্বারকা- দ্বারকা শহরটি তৈরি করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর দাদা বলরাম। দ্বারকাকে 'মুক্তির দ্বার' বলা হয়। এখানকার দ্বারকাধীশ মন্দিরে, ভগবান কৃষ্ণ তাঁর জন্মদিনে স্বর্ণ, হীরা, পোখরাজ এবং অন্যান্য মূল্যবান রত্ন দিয়ে সাজানো হয় শ্রীকৃষ্ণকে। এই সময় ভক্তরা ভগবানের আশীর্বাদ পেতে এই সুন্দর শহরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...