বাংলা সাহিত্যকে যদি পোশাকের সঙ্গে তুলনা করা হয়, রহস্য রোমাঞ্চ অবশ্যই সেই পোশাকের সঙ্গে লেগে থাকা অলংকার, যার শোভায় সুরভিত ও সুশোভিত হয়েছে বাংলা সাহিত্য।
রহস্য গল্প বলতে আমরা সাধারণত বুঝি কৌতূহলের চরমসীমা, গল্পের সঙ্গে জুড়ে থাকা সাসপেন্সের গন্ধ এবং অবশেষে সমাধান সূত্র দিয়ে গাঁথা জমজমাট ক্লাইম্যাক্স। এ সব কিছুর সঙ্গে দুঃসাহসিক অভিযান যাত্রা জুড়ে দিলে যে উপাখ্যানের জন্ম হয় তা হল কাকাবাবুর গল্প।
এই কাহিনীর স্রষ্টা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। কাকাবাবু ওরফে রাজা রায় চৌধুরী প্রাক্তন কেন্দ্রীয় সরকারি চাকুরে। কাকাবাবুর একটা পা ভাঙ্গা, ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটেন। এই সামান্য অসুবিধাই তাঁকে শক্তি দেয়। অসম্ভব মানসিক শক্তিকে তিনি পরিণত করেছেন জীবনীশক্তিতে। অদম্য মনের জোর কাকাবাবুর। তীব্র বিশ্লেষণ শক্তি, অসাধারণ পান্ডিত্য সব মিলিয়ে কাকাবাবু যেন আমাদের ইচ্ছেশক্তির প্রতীক। তাঁর ভাইপো ও সহযোগী সন্তুকে সঙ্গে নিয়ে একের পর এক অভিযান সম্পন্ন করেছেন।
প্রত্যেকটা অভিযান যেন একেকটা রূপকথা। রহস্যরা যেন সেই রূপকথার রাজকন্যা। অশুভ শক্তি রুপী দুষ্টু দৈত্য তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। কাকাবাবু ও সন্তু যেন তাদের বুদ্ধিমত্তায় আর মনের জোরে পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চেপে রহস্যের কাছে পৌঁছেছে। তারপর সাহসের সোনার-কাঠি ছুঁইয়ে রহস্যকে জটমুক্ত করে শুভশক্তির স্বার্থ রক্ষা করেছে।
কাকাবাবুর অভিযানগুলোকে দুঃসাহসিক ভ্রমণ-কাহিনীও বলা যেতে পারে। এখানে রহস্যের জট, সাসপেন্স প্রাধান্য পেলেও সেই রহস্যের সমাধানসূত্র অবধি পৌঁছানোর যাত্রাপথেই মূল আকর্ষণ।কখনো সেই যাত্রাপথ শত্রুর আক্রমণপূর্ণ কখনো আবার প্রাকৃতিক দুর্যোগেরও মোকাবিলা করতে হয়েছে কাকাবাবু ও সন্তুকে।
কাকাবাবুর সব গল্পের কথক সন্তু। প্রত্যেক অভিযানেই সঙ্গী হয়েছে সন্তু। কখনো কোন অভিযানে কাকাবাবু তাকে সঙ্গে না নিতে চাইলেও কাকাবাবুর সুরক্ষার বিষয়ে কোনরকম কার্পণ্য না করে সন্তু তাঁর পাশে থেকেছে। কাকাবাবুর গল্পগুলোতে কখনো সন্তুই কাকাবাবু অভিভাবক হয়ে উঠেছে। লেখকের এই চিন্তাভাবনা বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন মানুষদের সম্মান করতে শেখানোর বার্তা। শারীরিক যে কোনো প্রতিবন্ধকতাই যে শুধুমাত্র মানসিক শক্তি দিয়ে জয় করা যায় কাকাবাবু তার দৃষ্টান্ত। এই সাহিত্য কিশোর সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত হলেও যেকোনো বয়সের পাঠকের মনে 'থ্রিল' শব্দের প্রকৃত অর্থ পৌঁছে দিতে কাকাবাবুর জুড়ি মেলা ভার।
১৯৭৯ সালে "ভয়ঙ্কর সুন্দর" গল্পটি প্রকাশের মাধ্যমে কাকাবাবু সঙ্গে পরিচিত হন পাঠকেরা। তারপর জনপ্রিয় সিরিজ চলেছে প্রায় ৩৩ বছর ধরে। লেখকের প্রয়াণে ২০১২ সালে থেমে যায় সৃষ্টি। কাকাবাবুর সিনেমার পর্দায় সেভাবে বিচরণ করার সুযোগ হয়নি এখনো পর্যন্ত। তবে পরিচালক সৃজিত মুখার্জির হাত ধরে 'কাকাবাবু' বইয়ের পাতা থেকে সিনেমার পর্দায় দেখা দিতে শুরু করেছেন। কাকাবাবু সিরিজে প্রায় ৩৬টি উপন্যাস রচনা করেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
কাকাবাবু ও সন্তুর অভিযান মানে শুধু তুখোড় বুদ্ধি দিয়ে শত্রুকে পরাস্ত করা নয়, প্রাকৃতিক নৈসর্গিক বর্ণনারও সম্ভার কাকাবাবু সমগ্র। প্রাক্তন সরকারি কর্মী ও প্রচুর পড়াশোনা করা কাকাবাবু কিন্তু যুবক নন। তাঁর যুবক বয়সের কোনো অ্যাডভেঞ্চারের উল্লেখ সেভাবে পাওয়া যায়নি। তবে তিনি যে চাকুরীক্ষেত্রে নানা দুর্গমতাকে জয় করেছেন এবং অসম্ভব সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন সে উল্লেখ রয়েছে বইতে।
লেখককে কাকাবাবু চরিত্র সৃষ্টির অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন কোন এক অচেনা মানুষ। লেখক একবার একটা পায়ে অসুবিধাযুক্ত এক মানুষকে খুব উঁচু পাহাড়ে উঠতে দেখেছিলেন। তাঁর চোখে-মুখে কষ্টের ছাপ ছিল না। সেই ভয়হীন মানুষটি কাকাবাবু চরিত্র সৃষ্টির অনুপ্রেরণা। তবে লেখক এর ভাষায় "কাকাবাবু ডিটেকটিভ নন। কোনো খুন-ডাকাতির তদন্ত করেন না। রহস্যময় দুঃসাহসিক অভিযানে তাঁর আগ্রহ। সন্তুও তাতেই মেতে ওঠে"। আর পাঠককেও যে এই দুই সাহসী মানুষ মাতিয়ে রেখেছেন তা বলাই বাহুল্য।