রাজনিতী থেকে সাধারণ মানুষের মুখে হিন্দু মুসলমানের নিয়ে তরজা লেগেই আছে কিন্তু খুব কম মানুষই তাঁদের গভীর সম্প্রিতির দিকটি তুলে ধরে। সারা ভারতের কোনায় কোনায় ছড়িয়এ আছে সেই সম্প্রতির গাথা। কিন্তু তার খোজ আমরা কজনই বা রাখি।
বৃহস্পতিবার উদযাপিত হবে কোচবিহারের মদনমোহন বাড়িতে রাস উৎসব। প্রায় দুশো বছরেরও বেশি পুরানো এই উৎসব। কিন্তু রাস উৎসবের রাসচক্র যিনি তৈরি করেন তাঁর নাম আলতাব মিয়া। একটু খটকা লাগল? হ্যাঁ ঠিক চিরাচরিত হিন্দু উৎসবের যিনি রাসচক্র বানান তিনি কোনও হিন্দু বংশদ্ভুত নন, তিনি একজন মুসলিম বংশদ্ভুত। বিভাজন কারীদের অবশ্য একথায় গায়ে ছ্যাকাও লাগতে পারে। বাস্তবে এই সম্পর্ক অনেক গভীর। যা কোনও জাতপাতের গন্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়। রাজার আমল থেকেই বংশ পরম্পরায় এই রাসচক্র বানাচ্ছেন আলতাব মিয়ার পরিবার। শুধু তাই নয় লক্ষ্মীপুজোর দিন থেকে নিরামিষ খাবার খেয়ে আলতাব তাঁর বাবার মতোই নিষ্ঠাভরে রাসচক্র বানান।
মঙ্গলবার নিজের বাড়িতে বসে আলতাব মিয়া বানাচ্ছিলেন সেই রাসচক্র। তার গলায় উঠে আসে উগ্র ধর্মীয় ভাগাভাগির বিরুদ্ধে গভীর তিক্ততা। তিনি বলেন রাসচক্র বানানো আমাদের রক্তে। ইতিহাসের পাতা উল্টে তিনি বলেন মদনমোহনের ভক্ত ছিলেন কোচবিহারের রাজারা। আলতাবের পিতামহ পানমামুদ মিয়াকে রাসচক্র বানানোর দায়িত্ব দিয়েছিলেন রাজা। তারপর সেই দায়িত্ব নেয় তাঁর ছেলে আজিজ মিয়ার এরপর পরম্পরা অনুযায়ী রাসচক্র বাবানোর শিল্পী বা কারিগর হন আলতাব। সেদিন রাজা ভাবেননি আলতাবরা হিন্দু না মুসলমান। সেদিনও তাদের পরিচয় ছিল শিল্পি এবং আজও সেই রীতিই জারি আছে।
গর্বের সুরে আলতাব বলেন ‘‘বাবা আমায় শিখিয়েছিলেন রাসচক্র বানাতে। আমিও সেই শিক্ষা দিয়ে যায় আমার উত্তরসুরীকে।এটাই কোচবিহারের মাটির গুন।’’ তাঁর হাতে তৈরি রাসচক্র রাস পূর্ণিমার দিন থেকে কোচবিহার মদন মোহন বাড়িতে ঘোরাবেন লক্ষ লক্ষ মানুষ।
আলতাব মিয়ার মুখে রাসচক্রের বিবরণটা খানিকটা এরকম। রাস উৎসবের জন্যই প্রতি বছর নিয়ম করে বানাতে হয় রাসচক্র। কাগজ কেটে কেটে বাঁশের ওপর আটকাতে হয়। এবং সেই কাগজে হাতে এঁকে ফুটিয়ে তুলতে হয় রাসের নানা কাহিনি। রাসচক্র আকারে আটকোণা। হিন্দু, শিখ, মুসলমান আর বৌদ্ধ ধর্মের মিশ্রনেই চিত্রিত রাসচক্র। হিন্দু বত্রিশকোটি দেবতার ছবি থাকে এই রাসচক্রে। অনেকটা বৌদ্ধ মনির মতো দেখতে রাসচক্র হাত দিয়ে ঘুড়িয়ে দেখতে হয়। আলতাব মিয়া নিজেই বলেন আমি যখন এই চিত্র বানাই তখন নিজের জাত ভুলি যাই, এটাই প্রকৃত শিল্পের ধর্ম। তাঁর কথায়, ‘‘রাসচক্র আসলে সব ধর্মের সমন্বয়ের প্রতীক।’’