কাঁঠালিয়ার হিন্দুরাই বানাচ্ছেন মসজিদের মিনার!

 মুর্শিদাবাদের  কাঁঠালিয়া  গ্রাম  বিখ্যাত  তার  লাল-কালো  ডোরাকাটা  মাটির  পুতুলের জন্য।  কিন্তু  পুতুলের  সঙ্গে  সঙ্গে  আরও  এক  বিশেষ শিল্পের  জন্য  আন্তর্জাতিক  খ্যাতি  অর্জন  করেছে এই গ্রাম।  আজ  সেই  কথাই  বলবো।

   মসজিদগুলো একটু ভালো করে প্রত্যক্ষ করলে দেখা যাবে যে, সেখানে লাগানো থাকে মাটির  তৈরি  কালো মিনার।  সারা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের  নানান  মসজিদে  লাগানো  এই  মাটির  তৈরি কালো মিনার, একমাত্র  কাঁঠালিয়ার  মৃৎশিল্পীরাই   বানান।  সব  থেকে  অবাক  করার   মতো  ব্যাপার  হল,  এই   গ্রামে  মসজিদের  মিনার  তৈরির  ইতিহাস  কিন্তু হাজার বছরের পুরোনো। কারণ গ্রাম থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরে  প্রাচীন  বাংলার  প্রথম  স্বাধীন   নৃপতি  শশাঙ্কের  রাজধানী  কর্ণসুবর্ণ  বা  কানসোনার ধ্বংসস্তূপে প্রত্নতত্ত্ববিদরা খনন কার্য চালিয়ে খুঁজে পেয়েছিলেন  কালো মিনার।  এখনো  অবিকল  সেই  রকম মিনারই এখন তৈরি হয়ে আসছে। এখন গ্রামের বাজারপাড়া  বা  পালপাড়াতে  মাটির  কাজে  যুক্ত রয়েছে ১৮৫টি পরিবার।  তবে  মিনার  তৈরির  কাজ   করেন ১৫-২০টি পরিবার।  আবার  মিনার  শিল্পীরা কিন্তু সবাই  হিন্দু।  জনশ্রুতি  আছে, যে, মিনার শিল্পীদের পূর্বপুরুষরা  মোটামুটি  হাজার  বছর আগে বারাণসী থেকে  বাংলায়  এসেছিলেন।  তাঁদের  পদবি  তখন  ছিল ‘পণ্ডিত’। তবে এখন কাঁঠালিয়ার সব মিনার শিল্পীদের পদবিই  হল  ‘পাল’।   এঁদের  মধ্যে  সাধন  পাল, জগন্নাথ পাল, সুরজিৎপাল, দুলালপাল, সঞ্জয় পালের  সুনামের পরিধি  খানিক বিস্তৃত , তবে  বাকিরাও  কিন্তু  কম  যান  না।   

এই মিনার তৈরির এক আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে।  গঙ্গার পলিমাটি দিয়ে বানানো মিনার তৈরি  করার  পর  আগুনের  ধোঁয়া  খাওয়ানো  হয়  তাতে। এর ফলে পুরো মিনারটাই  হয়ে যায় কালো।  এমনকি  মিনার  ভাঙলে  দেখা যাবে,  ভেতরটাও কালো হয়ে গেছে।  এটাই  কাঁঠালিয়ায় তৈরি মিনারের বৈশিষ্ট্য। কিছু  মিনারে  অবশ্য  ধোঁয়া  খাওয়ানো  হয়না।  তখন  সেই   মিনারের  রং হয় লাল।  এই  মিনারগুলোকে  লাঠি দিয়ে  বাজালে  কাঁসার  বাসনের  মতো  শব্দ  হবে।  মিনারগুলো  আড়াই  থেকে পাঁচ-ছয় ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। মিনার যতই পুরোনো হোক না কেন, কোনোভাবেই এগুলির  কোনো  ক্ষয়  হয়  না।

 সারা  ভারতের  নানা  প্রান্তের মসজিদে, এমনকি বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানেও পাড়ি দিচ্ছে এই মিনার। কাঁঠালিয়ার বাইরেও কিছু মৃৎশিল্পীরাই বিকল্প  মিনার  তৈরি  করার  চেষ্টা  করলেও  হয়েছে  ব্যর্থ।  এর ফলে সারা, ভারতের যে কোনো অঞ্চলের মসজিদে যদি কালো মিনার দেখা যায়, তাহলে নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে, সেই মিনার তৈরি হয়েছে কাঁঠালিয়াতেই।  আবার  বেশ কিছু হিন্দু মন্দিরেও চূড়াতেও এখানকার মিনার  লাগানো  হয়। মসজিদের মিনারগুলোর ওপরে থাকে গম্বুজের মতো ছুঁচলো অংশ। আর মন্দিরের মিনারগুলো হয় লাল রঙের, তাদের আগায় ঘটের মতো কারুকার্য থাকে, ঘটের ওপর বসানো হয় ত্রিশূল। অবশ্য লাল  মিনারকে প্রয়োজনে  বিভিন্ন  রং করা হয়। যাই হোক, কাঁঠালিয়ার  এই  মৃৎশিল্পের আন্তর্জাতিক খ্যাতি  নিঃসন্দেহে  পশ্চিমবাংলার  সাফল্যের  শিখরে  এক  অনন্য   মাত্রা   যোগ  করেছে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...