পরনে কালো মিনি স্কার্ট আর সাদা পোলকা ডটের ফ্রন্ট-নট ব্লাউস টপ। কিশোরী চোখের দুরন্ত এক্সপ্রেশনে ১৬ বছর বয়সেই হয়ে উঠেছিলেন রাতারাতি তারকা। যাকে বলে একেবারে ‘ওভার নাইট স্টার’! এক ছবিতেই কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন সত্তর দশক। ১৯৭৩-এ মুক্তি পেয়েছিল রাজ কাপুরের ‘ববি’। এ ছবি যতটা রাজ কাপুরের তার চেয়ে বেশি ডিম্পল আর ঋষি কাপুরের। লোকমুখে ঋষি তখনও ‘চিন্টু কাপুর’। ডিম্পলের সাদা পোলকা ডটের নামই হয়ে গিয়েছিল ‘ববি প্রেন্ট’। বক্স অফিসে ৫.৪৫ কোটি টাকা আয় করেছিল ছবি। ৭৩’এই ছবিই সর্বোচ্চ আয় করেছিল ইন্ড্রাস্ট্রিতে। ডিম্পলের জন্য পাগল আম জনতা! কিন্তু ববির ছোটফটে মেয়েটা নিজের জীবনে যেন আরও বেশি ছটফটে!
প্রযোজক থেকে দর্শক- তাঁকে সিনেমার পর্দায় দেখার জন্য মুখিয়ে থাকলেও তিনি বেছে নিলেন অন্দর। ১৯৭৩-এ বয়সে দুম করে বিয়ে করে ফেললেন বিগেস্ট স্টারকে। বলিউডের ‘সত্তরের সেনসেশন ডিম্পল’ হয়ে উঠলেন ‘মিসেস রাজেশ খান্না’, সুপারস্টার রাজেশ খান্নার স্ত্রী। ডিম্পল ১৬ আর রাজেশ ৩১। সিনেমাকে বিদায় জানালেনও ওই ষোলতেই। ২৫ বছর বয়সে দুই কন্যার জননী। কিন্তু তাঁর জীবনের নিয়তি সিনেমা। তাই ঘুরপথে ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্যে দিয়ে হলেও তাঁকে ফিরতেই হল সিনেমার কাছে।
১৩ বছর পর বলিউডে কামব্যাক করলেন তিনি। নেপথ্যে বিচ্ছেদ।
বলিউডের সুপারস্টার রোমান্স কিংকে বিয়ে, কিন্তু দুই কন্যা ছাড়া জীবন তাঁকে কোনও রূপকথা উপহার দেয়নি। সুপারস্টারের প্রেমে পড়া, মুগ্ধ হওয়া এক জিনিস আর এল ছাদের তলায় বাস আর এক জিনিস। ১৯৮২ তে রাজেশের থেকে আলাদা হয়ে গেলেন ডিম্পল।কিন্তু ডিভোর্স নয়।
ডিম্পল ফিরে এলেন বায়োস্কোপের জগতে। তখনও তিনি দর্শকদের স্মৃতিতে টাটকা।উত্তাপ ছড়ান তাদের মনো জগতে। পরে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন এতটাই অপরিণত ছিলেন যে নিজের কেরিয়ারে ‘ববি’র গুরুত্ব তখন তিনি বুঝতে পারেননি। বিয়ের পর রাজেশের বাংলো ‘আশীর্বাদ’-এ প্রবেশ করেই বুঝতে পেরেছিলেন এ বিয়ের যাত্রাপথ সহজ হবে না।
ইন্ড্রাস্ট্রিতে ১৩ বছর পর ফিরে আসা সহজ নয়। তায় আবার দুই কন্যার মা। দর্শক নেবে তো?
১৯৮৪তে তাঁর কামব্যাক ছবি ‘জখমি শের’। ফ্লপ করল সেই ছবি। তবে আরও একবার নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ পেলেন তিনি। পরের বছর মুক্তি পেল রমেশ সিপ্পির ‘সাগর’। ১৯৮৫-তে ফের একবার ফিরে এল ‘ববি-জুটি’। ‘সাগর’ ছবি দিয়ে। পর্দায় ফের ম্যাজিক দেখল দর্শক! এ ছবিও ব্লকব্লাস্টার হিট!
সাগরের ঢেউ দর্শকদের কাছে এক ধাক্কায় ফিরিয়ে দিল পুরনো ডিম্পলকে। নিভতে বসা ডিম্পল আগুন জ্বলে উঠল দ্বিগুণ হয়ে। পর্দার মোনা দি’সিলভার আবেদনে পতঙ্গের মতো ধরা দিল দর্শক। সাফল্যের স্বাদ যেন এভাবে আর আসেনি আগে।
শুনলে সিনেমা মনে হয়, আসলে কিন্তু জলজ্যান্ত জীবন। বারবার বিপর্যয়ে পড়লেও সেসব নিয়ে তাঁকে বিশেষ আফসোস করতে দেখা যায়নি। এক ফোঁটা জলও ঝরেনি পীতবর্ণ চোখে।
জীবন যেভাবে ধরা দিয়েছে, তিনি ঠিক সেভাবেই গ্রহণ করেছেন তাকে। নিজের শর্তে, নিজের নিয়মে বেঁচে থাকায়।
সিলভার স্ক্রিনে নতুন নতুন রূপে ডিম্পলকে আবিষ্কার করতে লাগলেন দর্শকরা। ১৯৮৭-তে মহেশ ভটের ‘কাশ’, ১৯৯০’তে গোবিন্দ নিহালনির ‘দৃষ্টি’, ১৯৯১তে ‘লেকিন’, গুলজারের ‘লোকম’ এবং ১৯৯৩তে ‘রুদালি’- এই সব ছবিতে নবজন্ম ঘটেছিল অভিনেত্রী ডিম্পলের। ‘প্রহার, ‘অঙ্গার’, ‘গার্দিশ’, ‘ক্রান্তিবীর’-এর মতো ছবিতে সহ অভিনেত্রী হিসেবেও এতটাই তুখোড় ছিলেন যে দর্শকদের নজর তাঁর ওপর থেকে সরত না। তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছিল কল্পনা লাজমির ‘রুদালি’। ব্যক্তিগত জীবনে যত কাঁটার ঘায়ে অস্থির হয়েছেন ততটাই নিজেকে নিংড়ে দিয়েছেন অভিনয়ে।
অভিজাত সৌন্দর্য। উপচে পড়ছে এলিগেন্স। তুরস্কসুন্দরী ভেবে ভুল হয়, দিব্যি কিন্তু মানিয়ে গিয়েছিলেন প্রত্যন্ত মরু গ্রামের ভাড়া করা কাঁদিয়ে কন্যের চরিত্রে। শুধুমাত্র শরীর নয়, রূপ নয়, নজর কেড়েছিল অভিনয়। দর্শক দৃষ্টিতে শুধুই মুগ্ধতা। যতদিন এগিয়েছে তত বেছে বেছে কাজ শুরু করেছেন। নিজের ব্যবসায় মন দিয়েছেন।
মাত্র ৫ বছর তখন বয়স। বাবাকে বলেছিলেন, তিনি অভিনয় করতে চান। শৈশবের ভাবনা বদলে যায়নি কৈশোরে। ঝড় তুলে শুরু করা ডেবিউ ইনিংসে সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে তেমনই ঝোড়ো বিদায় নিলেও ইন্ড্রাস্ট্রিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন জাত অভিনেত্রী কখনও মরে না। একটু আধটু ধূলো জমতে পারে কিন্তু তাকে বাতিল করবে সাধ্য কী!
পা রেখেছেন হলিউডে। ক্রিস্টোফার নোলনের ‘টেনেট’ ছবি দিয়ে। আছেন ওটিটি প্লাটফর্মেও।‘সাস বহু অউর ফ্লেমিংগো’তে ‘সাবিত্রী’র ভূমিকায় ডিম্পল দুরন্ত। ‘মার্ডার মুবারক’, ‘তেরি বাঁতো মে’ ‘পাঠান’, ‘ তাঁকে বলিউড ‘কামব্যাক কুইন’ বলে ডাকে। তাঁর দর্শনই হল, পিছিয়ে তুমি পড়তেই পারো, কিন্তু ফিরে আসার রাস্তাটা ভুলে যেও না।
কোন স্পিরিটে আজও এমন ঝকঝকে আর ধারালো তিনি? এ প্রশ্নের উত্তর তাঁর কাছে একটাই- ওয়ার্কস লাইক অ্যা ম্যানিয়াক’।
ভাঙ্গা দাম্পত্য, সম্পর্কের ব্যর্থতা, দুই কন্যাকে বড় করা, বলিউড কেরিয়ার, ব্যবসা, নিজের জীবন- এক হাতে এত দিক সামলালেন কীভাবে?
ডিম্পলের গোটা জীবনই এই প্রশ্নের উত্তর। জীবন দিয়ে তিনি জীবনকে খুঁজেছেন। জানেন ঝড়ের মধ্যে আশ্রয় খুঁজে না পেলে দাঁড়িয়ে থাকতে নেই। চলতে হয়। তাতে হয় ঝড় থেমে যাবে নাহলে কোথাও না কোথাও ঠিক খুঁজে পাওয়া যাবে আশ্রয়।
আজও তিনি বলিউডের সিগনেচার অফ এলিগেন্স। প্রথম দিনের মতোই ঝকঝকে।
আজকের দিনে বোম্বাই শহরে তাঁর জন্ম হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার ঠিক এক দশক বাদে। ১৯৫৭-তে।