সারা বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিভিন্ন ঋতুর বৈশিষ্ট্যগুলি পরিবর্তন হচ্ছে, তা আমরা বুঝতেই পারছি। আমাদের দেশে তো বটেই, বাইরের দেশেও গরমের আধিক্য বেড়ে গেছে, এ বছরই ফ্রান্স, আমেরিকা সহ বিভিন্ন দেশ চূড়ান্ত উষ্ণতা উপলব্ধি করেছে। আমাদের এদিকে মাত্রা ছাড়া গরম, মাত্রা ছাড়া বৃষ্টি পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে দিচ্ছে। গ্রিনল্যান্ড, আইসল্যান্ডের বরফের চাঁই গলছে। এর পাশাপাশি আবার একটি খবর আমাদের সতর্ক করার পক্ষে যথেষ্ট। ২০২১ সাল নাগাদ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হিমালয়ের হিমবাহগুলোর অন্তত এক তৃতীয়াংশ গলে যেতে পারে।
২০১৫ সালের ডিসেম্বরে প্যারিসে পরিবেশের বিপন্নতার প্রেক্ষিতে একটি সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল। সেই সম্মেলনে প্রথম একটি জলবায়ু চুক্তির ব্যাপারে সম্মত হয়েছিলেন বিশ্বনেতারা। ২০১৬ সালের এপ্রিলে ১৭৫টি দেশ ওই সমঝোতা চুক্তিতে সাক্ষর করে। বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির হার ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখা বাধ্যতামূলক করা হয় এবং ক্রমান্বয়ে তা দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসে নামিয়ে আনতে বিশ্বজুড়ে কার্বন নিঃসরণ কমানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এবারে লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, এই যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, সেই চুক্তির বাস্তবায়ন হলেও হিমালয়ের এক তৃতীয়াংশ গেলে যেতে পারে। আর যদি সেই চুক্তির বাস্তবায়ন না হয়, তাহলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। তখন হিমালয়ের হিমবাহগুলোর দুই তৃতীয়াংশ গলে যাবে। এর ফলে প্রায় ২০০ কোটি মানুষ বিপদের সম্মুখীন হবে। ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ইন্টিগ্রেটেড মাউন্টেন ডেভেলপমেন্টের এক প্রতিবেদনে এমন সতর্কতাই জারি করা হয়েছে। এই বিপদ মোকাবিলায় জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিজ্ঞানীরা আহ্বান জানিয়েছেন।
আফগানিস্তান থেকে শুরু করে মায়ানমার পর্যন্ত হিন্দুকুশ হিমালয় অঞ্চল অবস্থিত। এই অঞ্চলকে বিশ্বের 'তৃতীয় মেরু' হিসেবে দেখা হয়। আর্কটিক ও আন্টার্কটিকার পর এই অঞ্চলটিই সবচেয়ে বেশি বরফে আচ্ছাদিত। এই হিমবাহগুলো হিন্দুকুশ, হিমবাহ অঞ্চলে বসবাসকারী ২৫ কোটি মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ জল সংরক্ষণাগার হিসেবে বিবেচিত। এছাড়াও পাকিস্তান, চীন ও অন্যান্য দেশের চূড়া থেকে প্রবাহিত হওয়া বড় বড় নদীগুলির ওপর ১৬৫ কোটি মানুষ নির্ভরশীল। আইসিআইএমডি-র গবেষক ফিলিপাস ওয়েস্টার জানান, তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে ১৯৭০ এর দশক থেকে হিমালয় অঞ্চলের ১৫ শতাংশ বরফ উধাও হয়ে গেছে।
আইসিআইএমডি-র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে যদি বিশ্ব উষ্ণতা বৃদ্ধির হারকে ১ ডিগ্রি ৫ সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যায়, তা সত্ত্বেও ২১০০ সাল নাগাদ হিন্দুকুশ হিমালয় অঞ্চলের ৩৬ শতাংশ হিমবাহ গলে যাবে। উষ্ণতা বৃদ্ধির হার ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে গলবে ৫০ শতাংশ হিমবাহ। পাশাপাশি যদি কার্বন নিঃসরণ না কমে, তবে ক্ষতির পরিমান দুই তৃতীয়াংশে গিয়ে ঠেকতে পারে। উপরিল্লিখিত চুক্তিতে বলা হয়েছিল, গাছ, মাটি এবং সমুদ্র প্রাকৃতিকভাবে যতটা শোষণ করতে পারে, ২০৫০ থেকে ২১০০ সালের মধ্যে কৃত্রিমভাবে গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ সেই পর্যায়ে নামিয়ে আনা দরকার। আইসিআইএমডি-র গবেষক ফিলিপস ওয়েস্টার জানিয়েছেন, এই সংকট, এমন এক ধরনের জলবায়ু সংকট, যার কথা সাধারণ মানুষ ভাবতেও পারছেনা। ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেমা ওয়াধাম জানিয়েছেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবের সংকটে থাকা এই অঞ্চলটিকে প্রাধান্য দিয়ে যুগান্তকারী একটি কাজ হয়েছে। হিমালয়কে ঘিরে রাখা আটটি দেশের অনুরোধেই গবেষণাটি করা হয়েছিল। ২০০-রও বেশি বিজ্ঞানী পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে এই গবেষণায় নিযুক্ত ছিলেন। ওয়েস্টার জানান, এখনও পর্যন্ত হিন্দুকুশ হিমালয় অঞ্চলের বরফের ওপর জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব অজানাই রয়েছে। তবে গবেষকরা জানান এই বিপদ মোকাবিলায় ব্যবস্থা নিতে হবে। এবং অবশ্যই তা জরুরি ভিত্তিতেই নিতে হবে। হিমবাহ গলার কারণে ২০৫০ থেকে ২০৬০ সাল পর্যন্ত নদীর প্রবাহ বেড়ে যাবে। এতে হ্রদগুলোর উচ্চতা বেড়ে গিয়ে বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হবে। তবে অবশ্যই ২০৬০ সালের সময় থেকে নদীর প্রবাহ কমতে শুরু করবে। সিন্ধু এবং মধ্য এশিয়ান নদীগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করা হচ্ছে। নদী প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে হাইড্রো ড্যামগুলো থেকে যে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে, তা বন্ধ হয়ে যাবে। অঞ্চলের বেশিরভাগ বিদ্যুৎই এখান থেকেই উৎপন্ন হয়। তার প্রভাব পড়বে মূলত ওই অঞ্চলের কৃষকদের ওপর। তারা শস্য উৎপাদনের প্রয়োজনীয় জল পাবেননা। গবেষক ওয়েস্টার আরও জানান, এখন বর্ষাকালেও অতিরিক্ত বর্ষণ হচ্ছে। আগে ১০০ বছর পর পর যে রকমের বন্যা হত, এখন তা ৫০ বছর পর পরই দেখা যাচ্ছে। তাই তিনি জানান, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিশ্বের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট যে পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে, তা যদি বাস্তবায়িতও হয়, তবুও এক তৃতীয়াংশ হিমবাহ গলা থেকে হিমালয়কে আটকানো যাবেনা। এবং তার ফলে অবশ্যই ওই এলাকার বাসিন্দারা সমস্যায় পড়বেন। গবেষণার মধ্যে দিয়ে এটাই কিন্তু পাওয়া গেছে। তাই এখন থেকেই সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন এবং এর মোকাবিলায় কি করা যেতে পারে তার বিষয়ে ভাবনা চিন্তা করা প্রয়োজন।
(# ভিডিও: সৌজন্যে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি)