পেশায় গাইনোকোলজিস্ট। কোনো রোগী তাঁর কাছে চিকিৎসার জন্যে এলে তাকে খালি হাতে ফিরে যেতে হয় না। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে রোগীদের পরিষেবা দিয়ে থাকেন তিনি। মনে করেন, টাকাটাই জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। সম্প্রতি ল্যাপারোস্কোপিক হিস্টেরেকটমি সার্জারির যাবতীয় সরঞ্জাম কেনার জন্য ১০ লক্ষ টাকা দান করেছেন তিনি। এভাবেই জনসেবার স্বার্থে নিজেকে নিয়োগ করতে পেরে জীবনের অন্য মাত্রা খুঁজে পেয়েছেন হিমাচলের মান্দি জেলার বাসিন্দা ডঃ উদয় ভানু রাণা।
জুন মাসে তিনি সার্জেরির সরঞ্জামগুলি কেনেন এবং ২-৩ সপ্তাহের মধ্যেই তা হাসপাতালে এসে পৌঁছায়। আশ্চর্যজনকভাবে, আইজিএমসি শিমলা ও ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদ মেডিকেল কলেজগুলির মতো রাজ্যের প্রধান স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলিতে এইধরনের পরিষেবা এখনও অনুপস্থিত। গত সপ্তাহে, সাতজন রোগীকে বিনামূল্যে টিএলএইচ (টোটাল ল্যাপারোস্কোপিক হিস্টেরেকটমি) পরিষেবা দেন ৩৫ বছরের এই শল্যচিকিৎসক।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, “যাঁরা আমার কাছে চিকিৎসা করাতে আসেন, তাঁরা সবসময়ই আমাকে ডাক্তার হিসেবে ভরসা করেন। আসলে আমি আমার পেশাকে খুব ভালোবাসি। সার্জারি আমার আবেগের সাথে জড়িত। গ্রামীণ অঞ্চলগুলিতে স্বাস্থ্যব্যবস্থার মান উন্নত করার কাজে আমি সবসময়ই অংশ নিতে চেয়েছি। আমার উদ্দেশ্য হল মানুষের সেবা করা। প্রাইভেট সেক্টরগুলি ব্যতিক্রম, সেখানে মূলত কর্পোরেট চাহিদাগুলি প্রাধান্য পায়। কিন্তু পাবলিক সেক্টরগুলিতে আমি আমার পেশার প্রতি গভীর মনোনিবেশ করতে পারি।“
প্রসঙ্গত, ওপেন সার্জেরি অথবা ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি দু’টি উপায়ে সম্পন্ন করা যায়। ওপেন সার্জেরিতে প্রলেপের মাধ্যমে পেট কেটে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা যায়।
“ল্যাপারোস্কোপিক সার্জেরিতে, আপনাকে শুধু ১ সেমি ও ০.৫ সেমির দুটি ছিদ্র করতে হয়। এই ছিদ্রগুলির মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান হবে। সে ক্ষেত্রে পেট কাটার কোনো প্রয়োজন নেই। পেটে অস্ত্রপচারের ফলে সেখানে ১৫-২০ সেমির ক্ষতচিহ্ন থেকে যায় এবং তা সম্পূর্ণভাবে সেরে উঠতে দীর্ঘ নিরাময় প্রক্রিয়ার প্রয়োজন। একজন রোগীর পেটে অস্ত্রপচার হলে তাঁকে ৭-১০ দিন পর্যন্ত হাসপাতালে থাকতে হতে পারে, সেখানে ল্যাপারোস্কোপিক সার্জেরি রোগীদের জন্য অত্যন্ত উপকারী, এর ফলে ২৪ ঘন্টার মধ্যেই রোগীরা বাড়ি ফিরে যেতে পারেন। এটি সম্পূর্ণ যন্ত্রণাহীন প্রক্রিয়া। এর নিরাময়ের প্রক্রিয়াও খুব সহজ। আর খুব বেশি হলে ২-১ সপ্তাহের মধ্যেই রোগীরা পুনরায় নিজেদের পেশায় ফিরে যেতে পারেন।“ এমনটাই জানিয়েছেন ডঃ উদয় ভানু।
ওপেন সার্জেরির চেয়ে ঢের বেশি উপকারী এই সার্জেরি। এমনটাই মনে করছেন চিকিৎসকরা। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ও যন্ত্রণার হাত থেকে রোগীদের মুক্তি দিতে পারে এই সার্জারি। ডঃ উদয়ের একজন সহকর্মীর কথায়, “চিকিৎসার পর মহিলা রোগীরা যাতে দুর্বল না হয়ে পড়েন, সে বিষয়ে সবসময় খেয়াল রাখেন ডঃ উদয়। প্রাথমিক ভাবে, সরকারি প্রচেষ্টায় চিকিৎসাটির উপকরণগুলি কেনার চেষ্টা করেছিলাম আমরা। এমন নয় যে তাঁরা আমাদের এই সুবিধা দিতে অক্ষম। যাই হোক, সার্জারির সরঞ্জামগুলি কিনতে আমাদের প্রায় একবছরের কাছাকাছি সময় লেগেছিল। দেখুন, পাবলিক সেটআপে কোথাও এই সার্জারির ব্যবস্থা নেই, বিশেষত গাইনোকোলজিতে।“
স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নতির উদ্দেশ্যে বিনামূল্যে এই সার্জারি করে থাকেন ডঃ উদয়। অন্যথায়, বেসরকারি হাসপাতালে এই চিকিৎসা ব্যবস্থার পরিষেবা পেতে গেলে হিমাচলের একজন রোগীকে ৫০,০০০ টাকা থেকে ১,০০,০০০ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করতে হয়। দিল্লী ও চন্ডীগড়ের কর্পোরেট হাসপাতালগুলিতে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে ১.৫ লক্ষ টাকা থেকে ৩ লক্ষ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়।
তবে ডঃ উদয়ের কাছে এসব অবান্তর। কারণ, স্বাস্থ্যের উন্নতির স্বার্থে জনসেবার কাজ তাঁকে প্রকৃত চেতনার পূর্ণতা এনে দিয়েছে।
“জনস্বাস্থ্যের দূরাবস্থা নিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত লড়াই করছি। এখানে উপকরণের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। বোধ হয় আপনি সম্প্রতি ডাক্তার নিগ্রহের ঘটনাটি পড়েছেন...কোনো ডাক্তারই চান না তাঁর রোগী যন্ত্রণা পাক অথবা মারা যান। আসল সমস্যা রয়েছে ব্যবস্থায়িক পদ্ধতিতে। আমাদের কাছে যথেষ্ট উপকরণ নেই, এ কারণেই মানুষকে যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়।“ বলছেন ডঃ উদয়।
যেখানে এখনও ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলিতে স্বাস্থ্য পরিষেবার দশা ভগ্নপ্রায়, সুচিকিৎসার জন্য প্রয়োজন যথাযথ উপকরণ, সেখানে নিজেকে জনসেবায় নিয়োগ করে স্বাস্থ্যব্যবস্থায় উন্নতি আনতে দৃষ্টান্ত রেখেছেন তিনি। সারা দেশে সর্বত্রই ডঃ উদয় ভানু রাণার মতো চিকিৎসক আমাদের ভীষণ ভাবে প্রয়োজন।