পাহাড়ে লঙ্কাকাণ্ড

আজ আমাদের লঙ্কা ছাড়া চলেই না। কিন্তু এককালে এই লঙ্কা ছিল বাঙালির পাক ঘরে অচল। যাকে বলে ব্রাত্য। বহু কাঠ-খড় পুড়িয়ে তাকে পাক ঘরের পাসপোর্ট জোগাড় করতে হয়েছে।

 

একটা সময় পর্যন্ত কোনও ভারতীয় রান্নাতেই উপকরণ হিসেবে লঙ্কার ব্যবহার হত না। অন্তত প্রাচীন কোনও খাবার সংক্রান্ত বইতে লঙ্কার উল্লেখ নেই। সে সময় রান্নায় ঝালের জন্য দেওয়া হত, আদা, পিপুল, মরিচ। ষোড়শ শতকে ভারতের লঙ্কার প্রবেশ ঘটে। লঙ্কার আদি বাড়ি বলিভিয়ায়। সেখান থেকে ল্যাটিন আমেরিকা, ইউরোপ ঘুরে ভাস্কো দা গামার হাত ধরে ১৪৯৮-তে ভারতীয়দের পাতে লঙ্কার আগমন ঘটে। আর আজ সেই লঙ্কাকে আমরা নিজেদের খাবারের এক অপরিহার্য উপাদান বানিয়ে ফেলেছি। এখন লঙ্কা ছাড়া খাবার খাওয়ার কথা আমরা ভাবতেই পারি না।

 

স্বামী বিবেকানন্দের অত্যন্ত প্ৰিয় ছিল লঙ্কা। দেশে তো বটেই, বিদেশেও লঙ্কা ছাড়া তাঁর খাওয়া হত না
স্বামীজির এহেন লঙ্কাপ্রীতি আমাদের সকলের জানা। একবার হরিপদ মিত্র তাঁর এত লঙ্কা খাওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করলে; তিনি বলেছিলেন, সন্নাসীদের পেটে কত দূষিত জল যায়! লঙ্কা হচ্ছে তার ওষুধ। অন্য সন্ন্যাসীদের যে কাজ চরস গাঁজা দিয়ে হয়, তিনি সেই কাজ লঙ্কা দিয়েই করতেন, এমনটাই তিনি বলতেন। আসলে লঙ্কাপ্রীতির কারণের নেপথ্যে রয়েছে অভাব, পরে তা অভ্যেস ও প্ৰিয় খাবারে পরিণত হয়। তিনি লঙ্কা খাওয়ার প্রতিযোগিতাও করতেন।

 

dallekhursani1

 

একবার এই লঙ্কা দিয়েই জব্দ করেছিলেন এক সাহেবকে। সাহেব তাঁর সব জিনিস ঘেঁটে দেখছেন, চেখে দেখছেন। সাহেবের এ স্বভাব যে স্বামীজির একেবারেই পছন্দ হয়নি, তা বলাই বাহুল্য! হঠাৎ লঙ্কা দেখিয়ে প্রশ্ন করলেন ঐ সাহেব। সাহেবের প্রশ্নের উত্তরে স্বামীজি বললেন, এগুলো ভারতীয় কুল। বলেই ঘরে থেকে সরে গেলেন...আর সাহেব বিবেকানন্দের কথা শুনে মুখে পুরেই বাঁধালেন লঙ্কাকাণ্ড

 

এবারের এই শরৎকালে উত্তরবঙ্গের পাহাড়ে বেঁধেছে লঙ্কাকাণ্ড। দার্জিলিং জেলার অন্যতম বিখ্যাত লঙ্কা হল ডলে খুর্সানি লঙ্কা। যা পৃথিবীর অন্যতম ঝাল লঙ্কা। লঙ্কার ঝাল মরিমাপের একক হল স্কোভিল। আবিষ্কারক বিজ্ঞানীর নামানুসারেই এই এককটির নামকরণ হয়েছে। ডল্লে খুর্সানি লঙ্কার ঝালের পরিমাণ হল এক লক্ষ থেকে সাড়ে তিন লক্ষ স্কোভিল। মূলত দার্জিলিং, সিকিম সংলগ্ন পার্বত্য এলাকায় এই লঙ্কার চাষ হয়। সবচেয়ে বেশি চাষ হয় সিকিমে। প্রতি বছর শুধু সিকিমেই প্রায় পঞ্চাশ টন ডলে খুর্সানি লঙ্কা উৎপাদিত হয়।

 

তবে এই লঙ্কা কিন্তু লম্বা নয়, বরং চেরির মতো ছোট এবং এর আকৃতি গোলাকার। দেখতে ভারী আকর্ষণীয় হলেও, এই লঙ্কা খেলে দমকল ডাকতে হতে পারে। তবে অন্য লঙ্কার তুলনায় ডল্লে খুর্সানির মধ্যে ভিটামিন এ এবং ভিটামিন ই-এর পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। কমলালেবুর থেকেও বেশি ভিটামিন সি রয়েছে এই লঙ্কায়। পটাশিয়ামের পরিমাণও বেশি এতে। এই সব উপাদান ডলে খুর্সানিকে স্বাস্থ্যসম্মত লঙ্কা করে তুলেছে।

 

dallekhursani2

 

এই বছর অর্থাৎ ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১-এ ডলে খুর্সানি লঙ্কার ভৌগলিক স্বত্ত্ব পেল বাংলার দুই পাহাড়ি জেলা, দার্জিলিং ও কালিম্পং। ভীষণই ঝাল এই লঙ্কা, এই লঙ্কার আচার দেওয়ারও চল রয়েছে, যা স্বাদে অতুলনীয়। এর চাটনিও তৈরি করা হয়। পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়া অনেক পর্যটকই এর স্বাদ নিয়েছেন, কিন্তু এইভাবে এর নাম হয়ত তারা জানতেন না।

 

বাংলার গৌরবের তালিকায় ডল্লে খুর্সানি লঙ্কাও এসে পড়ল। রসগোল্লা, জয়নগররের মোয়া, সীতাভোগ-মিহিদানার পরে বাঙালির গর্বের তালিকায় নবতম সংযোজন হল ডলে খুর্সানি। তাই মন খুলে ডল্লে খুর্সানি লঙ্কা খান, শুধু খেয়াল রাখবেন, খাওয়ার পরে মুখের ভিতরে যেন লঙ্কাকাণ্ড না বাঁধে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...