সবচেয়ে দুর্গম কিন্তু স্বয়ং সম্পূর্ণ দ্বীপ

দক্ষিণ আটলান্টিক সাগরের বুকে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের ফলে সৃষ্ট এক দ্বীপ ত্রিস্তান-ডি-কুনা। এই আগ্নেয়গিরি এখনো সক্রিয় আছে। দ্বীপটির আয়তন ৯৮ বর্গকিলোমিটার। বর্তমানে মাত্র ২৫০ জন লোক এই দ্বীপটিতে বসবাস করে। এর সবচেয়ে নিকটবর্তী শহর দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউন, সেখান থেকে এর দূরত্ব প্রায় ২ হাজার ৪৩২ কিলোমিটার। ভৌগোলিক ভাবে অত্যন্ত উচ্চগতির বায়ু প্রবাহ ও ঝড় প্রবণ এলাকায় আটলান্টিক সাগরের মাঝামাঝি দ্বীপটি অবস্থিত। পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন সমুদ্রপথ ছোট নৌকায় পাড়ি দিয়ে এখানে পৌঁছতে সময় লাগে প্রায় ১৫ থেকে ২০ দিন। আর সে কারণেই এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বিচ্ছিন্ন ও দূরবর্তী দ্বীপ হিসেবে বিবেচিত।

                       আগ্নেয়গিরি অগ্নুৎপাতের ফলে সমুদ্রের তলদেশ সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২০০০ মিটার উপরে উঠে এই দ্বীপের সৃষ্টি করেছে। ফলে পুরো দ্বীপটি পর্বত আচ্ছাদিত। শুধুমাত্র উত্তর পশ্চিম উপকুলের সামান্য কিছু অঞ্চল সমতল। সেখানেই আছে এই দ্বীপপুঞ্জের একমাত্র মানব বসতি। ১৫০৬ সালে সর্বপ্রথম এ দ্বীপের পাশ দিয়ে অতিক্রমকারী পর্তুগিজ নাবিক ত্রিস্ত-দা- কুনার নামানুসারে এ দ্বীপের নাম করা হয়।অত্যন্ত প্রতিকূল পরিবেশ হওয়ায় তিনি তখন দ্বীপে অবতরণ করতে পারেননি। ১৫২০তে আর একদল নাবিক দ্বীপটিতে প্রথমবার অবতরণ করেন।এর পর ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একাধিকবার এই দ্বীপে তাদের জাহাজ নোঙর করে। ১৭৬৭এ ফরাসী যুদ্ধ জাহাজ প্রথমবারের মতো পুরো দ্বীপটি জরিপ করে এবং মানব বসতির অনুমতি পায়।

              ১৮১০সালে স্থায়ী মানব বসতি শুরু হয়। ১৮১৬সালে ব্রিটেন তার তৎকালীন কেপ কলোনি থেকে দ্বীপটিকে নিজের অধিকারে নিয়ে নেয়। দ্বীপটি দখলের ক্ষেত্রে তাদের উদ্দেশ্য ছিল-ফরাসিরা সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসিত নেপোলিয়ানকে যাতে উদ্ধার করতে এই দ্বীপকে ঘাঁটি করতে না পারে।এই দ্বীপটি ব্রিটিশ ওভারসিস টেরিটরি বা ব্রিটেনের অধিকৃত অঞ্চলসমূহের অন্যতম।এখানে মুদ্রা হিসেবে যুক্ত রাজ্যের পাউন্ড,স্টার্লিং ব্যবহার হয়। ১৮৬৭সালে ব্রিটেনের রানীর দ্বিতীয় পুত্র ডিউক অফ এডিনবরা এই দ্বীপে আসেন। তখন তার সম্মানে এই দ্বীপের একমাত্র গ্রামটির নাম রাখা হয় এডিনবরা অফ দি সেভেন সিস।ত্রিস্তান দি কুনার অন্যান্য দ্বীপগুলো হলো নাইটেঙ্গল আইল্যান্ড ,মিডল আইল্যান্ড ,গগ আইল্যান্ড ইত্যাদি।বাকি দ্বীপগুলি মানব বসতির অনুপযোগী।    

         

               শুধু মাত্র গগ আইল্যান্ড এ একটি আবহাওয়া কেন্দ্র থাকায় সেখানে মাত্র ৬ জন কর্মী সর্বক্ষণের জন্যে বসবাস করেন। এই দ্বীপের জনসংখ্যা অতি সীমিত হওয়ায় যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো গড়ে ওঠেনি। ত্রিস্তান-দি কুনা যাবার একমাত্র বাহন নৌকা।আটলান্টিক মহাসাগরের মাঝামাঝি অবস্থিত হওয়ায় সবচেয়ে কঠিন সমুদ্রপথে এখানে পৌঁছতে সময় লাগে ১৫ -২০ দিন। এখানে 'এডিনবরা অফ সেভেন সিস' গ্রামে জীবনধারণের প্রায় সব ব্যবস্থাই আছে। বাসিন্দারা এখানকার জীবন যাপনে অত্যন্ত সন্তুষ্ট। এখানে তারা বৃহৎ পরিবারের মতো বাস করে। খাদ্য সামগ্রী থেকে শুরু করে সবই আপোষে নিজেদের প্রয়োজনানুযায়ী ভাগাভাগি করে নেয়। এদের মধ্যে এতটাই বিশ্বাসযোগ্যতা যে কারো বাড়িতে কোনো তালা নেই।

                        এই গ্রাম থেকে মাইল খানেক দূরে অবস্থিত কৃষিজমি। গ্রামের একমাত্র রাস্তা ধরে সেখানে যেতে হয়। জমিতে যাওয়ার জন্য বাস আছে - প্রতিটি পরিবারের জন্য একাধিক কৃষিজমি বরাদ্দ আছে। মূলত আলু চাষ হলেও পাশাপাশি প্রয়োজনীয় অন্যান্য সব্জির চাষ হয়। প্রত্যেকেই নিজেদের কাজ শেষ করে অন্যের কাজে যথাসাধ্য সাহায্য করে। কৃষির পাশাপাশি অন্য কাজ হলো গবাদি পশু পাখি পালন। দ্বীপের অধিবাসীদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমানে গরু, ভেড়া, হাঁস, মুরগী আছে। তাদের প্রয়োজনানুযায়ী এই পশুপাখীর সংখ্যা কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়।তারা নিজেদের খাবারের জন্য মাছ শিকার করে, তবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নয়। এছাড়া চিংড়ি শিকার করে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে। বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের অন্যতম মাধ্যম হলো ত্রিস্তান-দি-কুনার রক জাতের চিংড়ি। এছাড়া পর্যটন শিল্প (পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা, পর্যটন গাইড), বিভিন্ন হস্তশিল্প ও স্মারকপূর্ণ সামগ্রী বিক্রি করে তারা আয় করে। তাদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দেশের স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় ব্যয়িত হয়।

                        এর আগ্নেয়গিরিতে শেষ ১৯৬১ তে বিস্ফোরণ হয়। তাতে উত্তপ্ত লাভা পাহাড়ের গা বেয়ে সমুদ্রে পড়ে। মাত্র কয়েক কিলোমিটারের ব্যবধানে দ্বীপবাসী বেঁচে যায়। তবে তখনও দ্বীপটি নিরাপদ না থাকায় দ্বীপবাসীকে প্রথম কেপ টাউন পরে হ্যাম্প শায়রে নিয়ে যাওয়া হয়।  ইংল্যান্ডে নিশ্চিন্ত জীবনযাপন করলেও গ্রামের শান্তি হাতছানি দেয়। ১৯৬৩ এ ঝুঁকি নিয়ে তারা নিজেরাই দ্বীপে ফিরে আসে। আদিম কৃষি ও পশুপালন সমাজব্যবস্থা মেনে বর্তমানেও তারা শান্তিতে বসবাস করছে। প্রশাসনিক কাজ পরিচালনা করতে ব্রিটেনের রানীর পক্ষ থেকে ১জন প্রশাসনিক প্রধান নিযুক্ত হয়। দ্বীপের অধিবাসী থেকে নির্বাচিত ৮জন সদস্য তৈরী করে' ত্রিস্তান-দি-কুনা আইল্যান্ড কাউন্সিল’, দ্বীপের প্রশাসনিক প্রধান ও কাউন্সিল উভয়ই ৩ বছরের জন্য নির্বাচিত হয়। প্রশাসনিক ও কাউন্সিল হাউস এই দ্বীপের একমাত্র দোতলা ভবন। ত্রিস্তান-দি-কুনার নিজস্ব কিছু আইন আছে। আইনানুযায়ী বহিরাগত কেউ এসে স্থায়ী ভাবে জমি কিনতে বা বসতি গড়তে পারবে না। তবে দ্বীপবাসী চাইলে এই আইন পরিবর্তন সম্ভব। সেক্ষেত্রে ক্রেতাকে পুরো দ্বীপটি কিনতে হবে।

                      দুর্গম এলাকার নিয়মিত যানবাহন হলো দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসা  মাছ ধরার নৌকা। তবে সেগুলো বছরে ৮-৯ বার যাতায়াত করে। এছাড়া আর.এম.এস. সেন্ট হেলেনা থেকে ত্রিস্তান-দি-কুনা দ্বীপ হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা যায়। এই দ্বীপে কোনো মোবাইল ফোন কাভারেজ নেই, তবে যুক্তরাজ্যের টেলিফোন ব্যবস্থার অধীনে কিছু টেলিফোন আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের  সময় ব্রিটিশ রয়েল নেভি দক্ষিণ আটলান্টিক সাগরে জার্মান ডুবো জাহাজের উপর নজরদারি চালানোর জন্য এখানে রেডিও যোগাযোগ ব্যবস্থা সমৃদ্ধ বিশেষ ঘাঁটি স্থাপন করেছিল ব্রিটিশরা। ১৯৯৮সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত এখানে ইন্টারনেট পরিষেবা ছিল, কিন্তু এতো দুর্গম জায়গাতে ইন্টারনেট পরিষেবা ব্যয়বহুল হওয়ায় তা  ছিল দ্বীপবাসীর সামর্থ্যের বাইরে। তাই ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। সম্প্রতি ১ টা ইন্টারনেট ক্যাফের মাধ্যমে পরিষেবা দেওয়া হয়,যা দিয়ে শুধু ই-মেইল করা যায়।

               ত্রিস্তান দ্বীপের আশপাশ সামুদ্রিক জীব বৈচিত্রে ভরপুর। সমুদ্র তলদেশে নানান জলজ উদ্ভিদের বন গড়ে উঠেছে। কেল্প নামে দ্রুত বর্দ্ধমান উদ্ভিদ আছে যারা প্রতিদিন ১/২ মিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে ও ৪৫ মিটার উঁচু হয়। অন্যতম প্রাণী সাব এনেটিক ফসিলি ও নর্দার্ন রক কপার। বিলুপ্ত প্রায় মাছের অভ্যয়ারণ্য আছে এই দ্বীপের জলে। এই দ্বীপ নানা জীব বৈচিত্রে সমৃদ্ধ ও সুস্থ মানসিক পরিবেশের ইঙ্গিতবাহী ও স্বতন্ত্র - সাম্প্রতিক অস্থিরতার মাঝে অত্যন্ত শান্তিবাহী ও আকর্ষণীয় বিশ্বের ভ্রমণ পিপাসু মানুষদের কাছে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...