বেনিয়াটোলা স্ট্রিটের এই বাড়িতেই রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সঙ্গে পরিচয় হয় বঙ্কিমচন্দ্রের

ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব কবি অধরাল সেনকে বলেছিলেন "সংসার আসলে কর্মভূমি। এখানে কর্ম করতে আসা, যেমন দেশে বাড়ি, কলকাতায় গিয়ে কর্ম করে।' অধরলাল সেনকে  কাজে এভাবেই উদ্দীপ্ত করতেন শ্রী শ্রী ঠাকুর। অধরলাল সেনের বাবা রামগোপাল সেনের সুতোর ব্যবসা ছিল বড় বাজারের আরমানি স্ট্রিটে। তাঁদের পূর্বপুরুষ ঘনশ্যাম সেনের আদি বাড়ি ছিল হুগলি জেলার সিঙ্গুরে। গ্রাম ছেড়ে তিনি কলকাতায় এসে বসবাস শুরু করেছিলেন। ব্যবসা এবং নানা সুযোগ সুবিধার জন্য তখন মফঃস্বল বা গ্রাম ছেড়ে মানুষ কলকাতায় আসতে শুরু করেছেন। কিন্তু সকলেই কি সুযোগ-সুবিধার জন্য কলকাতায় এসে ততটা খুশি হতে পারতেন? অনেকের অন্তর্দ্বন্দ্বের খোঁজ হয়তো পাওয়া যেত না। কলকাতাবাসীর দেশের বাড়ির ওপর যে টান তা অস্বীকার করার উপায় বোধহয় আজও নেই।

 

রাম গোপাল সেন থাকতেন আহিরীটোলায় ২৯ নম্বর শংকর হালদার লেনে। ১৮৫৫ সালে এখানেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন অধরলাল। রামগোপাল পরে ৯৭ নম্বর বেনিয়াটোলা স্ট্রিটের বাড়িটি তৈরি করেছিলেন। এই বাড়িতেই ভক্ত অধর লাল-এর কাছে এসেছিলেন ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ।

 

অনেকগুলি বাড়ি তৈরি করলেও কোন বাড়ি খুব বিশেষ জাঁকজমক বা স্বাচ্ছন্দে পরিপূর্ণ ছিল না। একজন সম্পন্ন ব্যবসায়ীর বাড়ির কোন জাঁকজমক বা বিলাসিতা ৯৭ নম্বর বেনিয়াটোলা স্ট্রিটের বাড়িতে পাওয়া যায়নি। যদিও এই পরিবারটি ব্রিটিশ আনুকূল্য লাভ করেছিল বলেই ইতিহাস বলে। অথচ এই বাড়িতে শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা হতো কিন্তু বাড়ির আকৃতি যথেষ্ট সাদামাটা ছিল। মধ্যবিত্ত বাঙালির বসতবাড়ির মতোই সাধারণ বাড়ি ছিল। ঠাকুর রামকৃষ্ণের পদার্পণ এবং অধরলালের কাব্যচর্চাই এই বাড়িকে অসাধারণত্বের মোড়কে আবৃত করে। 

 

১৮৭২ সালে অধরলাল এন্ট্রান্স পরীক্ষায় অষ্টম স্থান পেয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ১৮৭৪ সালে ওই কলেজ থেকে তিনি পাস করেছিলেন ফার্স্ট আর্টস। এই পরীক্ষায় তিনি পেয়েছিলেন চতুর্থ স্থান এবং পরে ইংরেজিতে ডাফ স্কলারশিপ। ১৮৭৪ সালেই অধরলালের দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। ললিতাসুন্দরী ও মেনকা। 

 

"দ্যা স্রাইনস অফ সীতাকুণ্ড" বইটি অধরলাল সেন নিজে রচনা করেছিলেন। তাঁর সহপাঠী ছিলেন বিখ্যাত ইতিহাসবিদ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। ১৮৭৭ সালে অধর লাল আরো দুটি কাব্যগ্রন্থ বের করেছিলেন। 'নলিনী' ও 'কুসুমকানন'। 

 

পড়াশোনা এবং বিদ্যাচর্চা নিয়েই থাকতেন অধরলাল। ১৮৭৯ সালে চট্টগ্রামের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছিলেন অধরলাল সেন। ভারতের তদানীন্তন বড়লাট লর্ড লিটনের কবিতার অনুবাদ গ্রন্থ লিটোনিয়ানা এই সময় প্রকাশিত হয়েছিল। কবি অধরলাল সেন তাঁর অনেক কাব্যগ্রন্থই বিভিন্ন ব্রিটিশ কবি এবং ব্রিটিশদের উৎসর্গ করে গেছেন। চাকরি শুরু করার তিন বছরের মধ্যেই তিনি কলকাতার ডেপুটি কালেক্টরের পদে নিযুক্ত হন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ফেলোশিপ তিনি পেয়েছিলেন। 

 

অধর লালের বেনিয়াটোলা স্ট্রিটের বাড়িতে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বহুবার এসেছেন। এই বাড়িতেই তাঁর পরিচয় হয়েছিল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। খুব অল্প বয়সেই পৃথিবী থেকে চলে যান অধর লাল। যখন তিনি মারা যান তার বয়স ছিল মাত্র তিরিশ বছর। কাব্যচর্চার জন্যেই তিনি সাহিত্যের ক্ষেত্রে নিজস্ব জায়গা তৈরি করতে পেরেছিলেন, যে কারণে অধরলালের বাড়ি ইতিহাসের পাতায় নিজের জায়গা করে নিয়েছে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...