‘ইয়ং বেঙ্গল’-এর শিক্ষক

সময়টা বাংলার 'অন্ধকার' যুগের। স্বাধীনতাহীনতা এবং ইংরেজ শাসনে অত্যাচারিত-অবহেলিত বাংলা তথা দেশ অথচ ঠিক সেই সময়ই আদ্যপান্ত বিলিতি, পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত একজন 'ভারতীয়' আধুনিক-মুক্ত চিন্তা-চেতনার মানুষ উঠে পড়ে লেগেছিলেন যেভাবে হোক বাংলায় আনতে হবে নবজাগরণ, অন্ধকার ধুয়ে মুছে সাফ করে দিতে হবে। তিনি হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও

এক মিশ্র পর্তুগীজ পরিবারের সন্তান হলেও তাঁর জন্ম কলকাতার এন্টালিতে এবং তিনি নিজেকে আপাদমস্তক খাঁটি বাঙালিই ভাবতেন। তাঁরই একটি ইংরেজী কবিতায় তিনি লিখেছিলেন-

"My Country! In the days of Glory Past

A beauteous halo circled round thy brow

And worshipped as deity thou wast

Where is that Glory, where is that reverence now?"

dero-1

P.C: এন্টালিতে ডিরোজিও’র বাড়ি

ডিরোজিও একাধারে যেমন একজন কবি আবার একজন কুসংস্কারমুক্ত মানুষ, যিনি সামাজিক ধর্মীয় অন্ধ কুসংস্কারাছন্নতা থেকে নিজেকে এবং অন্যকে বের করে নিয়েছিলেন। তাঁর জ্বালানো জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হতে চেয়েছিল হিন্দু কলেজের ছাত্ররা। তিনিও তাঁর শৈশবে পেয়েছিলেন এক উদার চিন্তার শিক্ষককে, তিনি ছিলেন ড্রুমন্ড, একজন স্কটিশ। দারুণ প্রগতিশীল মানুষ ছিলেন তিনি। এই ড্রুমন্ডই ডিরোজিওর ভিতরে মুক্তচিন্তার বীজ বপন করে দিয়েছিলেন। ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য নানা বিষয়ে খুঁটিয়ে পড়াশোনা করতেন ডিরোজিও। ১৪ বছর বয়সে গঙ্গার শোভায় মুগ্ধ হয়ে কবিতা লেখা শুরু করেন। মাত্র ১৭ বছর বয়সে জার্মান দার্শনিক ইম্মানুয়েল কান্ট-এর কড়া সমালোচনা করে কলকাতার বুদ্ধিজীবি মহলে একেবারে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিলেন।

dero-2

P.C: পুরনো প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়

তখন ১৮১৭ সাল। ৪২ বছর বয়সী ধনী ঘড়ি ব্যবসায়ী ডেভিড হেয়ার বাংলার মানুষের দুঃখদুর্দশা দেখে মর্মাহত হয়ে ভাবলেন মানুষ শিক্ষিত হলে এই দুঃখদুর্দশা কিছুটা হলেও প্রশমিত হবে। প্রতিষ্ঠা করলেন হিন্দু কলেজ, অধুনা যা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় নামে পরিচিত। ডিরোজিও খবর পেয়ে আবেদন করলেন শিক্ষকতার জন্য। ১৭ বছর বয়সেই ইতিহাস ইংরেজীর শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন। ছাত্রদের সঙ্গে তাঁর বয়সের ব্যবধান ছিল খুব কম। কেউ কেউ ছিলেন তাঁর সমবয়সী। তাঁর প্রত্যক্ষ ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, প্যারীচাঁদ মিত্র, রাধানাথ শিকদার, রামতনু লাহিড়ী, শিবচন্দ্র দেব, দিগম্বর মিত্র, গোবিন্দচন্দ্র বসাক। তেমনই হরচন্দ্র ঘোষ, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় রশিককৃষ্ণ মল্লিক ছিলেন তাঁর ভাবশিষ্য। তবে শিক্ষাদানকে ডিরোজিও কেবল মাত্র ক্লাসরুমের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখেননি। ক্লাসের বাইরে তাঁর বাড়িতে কিংবা অন্যত্র তাঁরা মিলিত হতেন। তাই তিনি হয়ে উঠেছিলেন ছাত্রদের friend philosopher and guide ডিরোজিওর এই সব ছাত্ররা 'নব্যবঙ্গ' বা 'ইয়ং বেঙ্গল' নামে পরিচিত ছিলেন। ডিরোজিও উদাত্ত কন্ঠে তাঁদের আবৃত্তি করে শোনাতেন-

"Expanding like the petals of young flowers

I watch the gentle opening of your minds..."

dero-3

P.C: ডিরোজিও’র সমাধি

যে মানুষটি তাঁর উপলব্ধি আর কর্মোদ্যমে বদলাতে চেয়েছিলেন গোটা সমাজটাকে ১৮৩১-এর ২৬ ডিসেম্বর মাত্র ২২ বছর বয়সে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় তাঁর। নিরীশ্বরবাদী হওয়ায় এবং খ্রিস্টানসুলভ আচরণ পরিত্যাগ করেছিলেন বলে খ্রিস্টান ধর্মযাজকরা তাঁকে পার্কস্ট্রিটের কবরখানায় সমাধিস্থ করায় আপত্তি তোলে এবং তাঁকে সমাহিত করা হয় পার্কস্ট্রিট সিমেট্রির বাইরে রাস্তার উপর। আজ ১৮ এপ্রিল, বাংলার নবজাগরনের পুরোধা- ডিরোজিও' জন্মতিথি।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...