স্বপ্ন ছিল একদিন ঠিক পৌঁছে যাবে বিশ্বমঞ্চে। হাজার হাজার মানুষের চোখের সামনে raকেট হাতে জয় করে নেবে টেবিল টেনিস কোর্টে।
কিন্তু যুদ্ধ বিক্ষত এক দেশের মেয়ে হয়ে কী করে সম্ভব তা!
জল নেই। আলো নেই। ভাঙা রাস্তা। ভাঙা শহর। উড়ান বন্ধ। জীবন অনিশ্চিত। প্র্যাকটিস দুরস্থ।
এত কিছু সামলে কী করে পৌঁছানো যায় ওই স্বপ্নের কোর্টে।
বাকি বিশ্ব জানে না। কিন্তু বছর বারোর ওই মেয়ে জানে।
২০২০ টোকিও অলিম্পিকে শুরু থেকেই নজর কেড়েছে সে। নাম হেন্দ জাজা।
এবারের অলিম্পিকের সবচেয়ে কম বয়সের প্রতিযোগী।
অলিম্পিকে অভিষেকের সময় জাজার বয়স ১২ বছর ২০৪ দিন।
ছয় সদস্যের ছোট্ট দল নিয়ে অলিম্পিকের আসরে উপস্থিত হয়েছে সিরিয়া দল।
মার্চ পাস্টে জাজার হাতেই ছিল দেশের পতাকা।
টকটকে ফর্সা মুখ। এক পিঠ কোঁকড়া কোঁকড়া বাদামী চুল। ব্যান্ড দিয়ে বাঁধা। সেটাই যেন সিগনেচার হয়ে গিয়েছে জাজার। স্থির চোখ বলে দেয় এক যুগের জীবনে বহু ভাঙনের সাক্ষী এই কিশোরী।
১৯৬৮-র পর এত কমবয়সী প্রতিযোগী অলিম্পিকে আর দেখা যায়নি।
টোকিও অলিম্পিকে তার প্রথম ম্যাচ ছিল ৩৯-লিউ-এর বিপক্ষে। লিউয়ের বছর দশেকের এক কন্যা সন্তান আছে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে জাজা প্রায় তাঁর মেয়ের বয়সী।
লিউ-এর দীর্ঘ অভিজ্ঞতা এবং টেনিস কোর্টের ধাত বোঝার ক্ষমতার কাছে হেরে যায় জাজা।
প্রথম রাউন্ডে অস্ট্রিয়ার লিউ জিয়ার কাছে ৪-০ ব্যবধানে হার মানতে হয়।
কিন্তু লিউয়ের জিত অবলীলায় আসেনি। রীতিমতো লড়ে জিততে হয়েছে ম্যাচ।
ম্যাচ শেষে স্কোরবোর্ডে বিজয়ী হিসেবে লিউয়ের নাম লেখা হলেও তাতে এক চিলতেও কম হয় না জাজের কৃতিত্ব।
লিউ সাংবাদিকদের জানান, “তিনি মেয়েকে বলেছিলেন তোমার চেয়ে দু’বছরের বড় এক মেয়ের বিরুদ্ধে খেলতে নামছি, মেয়ের উত্তর ছিল, “দেখো, যেন হেরে যেও না…”
জাজাকে নিয়ে যে সামান্য হলেও চাপে ছিলেন তা কার্যত স্বীকার করে নেন তিনি।
গত ফেব্রুয়ারিতে ওয়েস্টার্ন এশিয়া অলিম্পিকে বিজয়ী হয়েছিলেন জাজ। বয়স তখন এগারো।
অতিমারীর জন্য অলিম্পিক না পিছলে ওই বয়সেই অলিম্পিকে নামত সে।
জাজা যে শুধু টেবিল টেনিস কোর্টের প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই করে তা নয়, তার লড়াইটা নিজের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই।
জাজার জন্ম সিরিয়ার হামা শহরে। বর্তমানে সিরিয়ার রাজধানী দামাস্কাসের বাসিন্দা।
চার ভাই-বোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট।
মাত্র পাঁচ বছর বয়সে হাতে র্যাকেট তুলে নিয়েছিলেন।
ঠিক ছয় বছর পর পশ্চিম এশিয়ার অলিম্পিক বাছাই পর্বে অংশ নেন জাজা। সেখানে লেবাননের টেবিল টেনিস তারকা মারিয়ানা শাহাকিয়ানকে হারান জাজা।
আজ পর্যন্ত জাজা যত প্রতিপক্ষকে হারিয়েছেন বয়সের বিচারে সকলেই প্রায় তার চেয়ে বড়।
সিরিয়ায় জাজার জীবন অনিশ্চয়তায় ভরা। চূড়ান্ত কঠিন লড়াই। প্রতিদিনই যুদ্ধ জিতে ফেরার মতো বেঁচে থাকা।
স্বাভাবিক জীবনযাপন কার্যত অসম্ভব। লোডশেডিং নিত্য সঙ্গী। রোজকার সাধারণ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও খুব কষ্ট করে জোগাড় করতে হয়।
একটা র্যাকেট, কিংবা বল সেটাও। প্র্যাকটিসের আধুনিক সুযোগ সুবিধা তো অনেক দূরের ব্যাপার।
জাজাকে কংক্রিটের ওপর, কাঠের টেবিলে প্র্যাকটিস করতে হয়েছে।
যুদ্ধের কারণে উড়ান বন্ধ থাকায় আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারেনি।
তবু হার মানেনি এই মেয়ে। স্বপ্নটাকে জাপটে ধরে রেখেছে। সম্বল জেদ বার একাগ্রতা।
টেবিল টেনিসের পাশাপাশি পড়াশোনাতেও সে সিরিয়াস ছাত্রী। ফার্মাসিস্ট নাহলে আইনজীবী হতে চায়।
জাজা বলেন, গত পাঁচ বছর ধরে বহু বিপর্যয় অস্থিরতা দেখেছি। হল ছাড়িনি। নিজের স্বপ্নটাকে ছাড়তে নেই। জয় হবেই।
খেলার মাধ্যমেই সিরিয়ার বিপর্যস্ত মানুষের মুখে একটু হলেও হাসি আনতে চান জাজা। অলিম্পিকের মঞ্চে দাঁড়িয়ে দেশবাসীকে তার বার্তা, “আমরা আছি আপনাদেরকে হাসি-খুশি রাখার জন্য”
দেশের উত্তাল অবস্থায় জাজা একমাত্র ভালো থাকেন র্যাকেট হাতে।
প্রথমবার ‘গ্রেটেস্ট শো’-এ এসে জাজা হেরেছেন ঠিকই, তবে প্রতিপক্ষ এবং খেলোয়াড় হিসেবে নিজের জাত চিনিয়ে…