মুম্বই-এর সিধু জ্যাঠা, ফয় নিসিন

বোম্বাই শহরটা তখনও ‘মুম্বই’ হয়ে ওঠেনি।  তবে শুরু হয়েছিল ভাঙন। স্থাপত্য ঐতিহাসিক ভবন, সাংস্কৃতিক সৌধ, মিনার নির্বিবাদে ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছিল। আকাশ ছোঁয়া ইমারতের ভিড়ে হারিয়ে যেতে বসেছিল এই শহরের সামগ্রিক চরিত্র। সময়টা নব্বই-এর দশক। তখনও মুম্বই-তে হেরিটেজ বাঁচাও আন্দোলন শুরু হয়নি।  একটা  শহর তার ঐতিহ্য, সভ্যতা, সংস্কৃতির শিকড় উপড়ে ফেললে যে একটা সময় মৃত নগরীতে পরিণত হয় সেই সত্য অনুভব করেছিলেন তিনি। তাই  হারিয়ে যেতে বসা ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে একাই নেমে পড়ে ছিলেন রাস্তায়।

FotoJet (152)

সঙ্গী বলতে শুধু একটা ক্যামেরা। আর প্যাশন।  মানুষটির নাম ফয়  নিসিন।  মুম্বই শহরের সিধু জ্যাঠা বলা জেতেই পারে তাঁকে। ইতিহাসের ছাত্র, গবেষক, স্থাপত্যবিদ তো বটেই, যারা শহর ভালবাসে, মুম্বই গড়ে ওঠার ইতিহাস জানতে চান তাঁদের কাছে  ফয়  নিসিন ছিলেন জীবন্ত এনসাইক্লোপেডিয়া। মুম্বই- এর গুগল।

মুম্বই শহরের বিভিন্ন গলি-রাস্তা,পুরনো বাড়ি, পরিতক্ত্য ভবনের ছবি তুলতেন তিনি। শহরের জীবনযাত্রা, মানুষের রোজনামচার মুহূর্ত ধরা পড়ত তাঁর ক্যামেরায়। এভাবেই  ঐতিহ্যকে ধরে রাখার কাজ করতেন।

FotoJet (151)

১৯৩১ সালে এক ডাচ পরিবারে তাঁর জন্ম হয়। ফয়  এর পিতামহ ১৮৫৭ সালে ইংল্যান্ডের ডেনমার্ক থেকে ভারতে আসেন।  জীবনজীবিকার উন্নতির আশায় একদিন চেপে পড়লেন ভারতগামী জাহাজে।  বরদার রাজার সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন।  ফয়  নিসিনের পুরো পরিবার ব্রিটিশ হলেও তাঁদের কর্মক্ষেত্র  বরদার রাজের প্রাইভেট আর্মি।

দেশ স্বাধীন হলেও ফয় পরিবার ভারতেই থেকে যায়।  গুজরাট থেকে তাঁরা মহারাষ্ট্রের পুনেতে চলে আসেন সেখানেই জন্ম হয় ফয়ের।

মুম্বইতে পড়াশোনা শেষ করে ফয়  ইংল্যান্ড যান। ফিরে ব্রিটিশ কাউন্সিলে যোগ দেন। বহুবছর সেখানকার সাংস্কৃতিক প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেন।

FotoJet (153)

১৯৬০- ১৯৭০ পর্যন্ত মুম্বইে তাঁর মতো স্থাপত্যের ইতিহাস জানা মানুষ আর কেউ ছিল না।  

তাঁর ছাত্র, বিকাশ দিলয়ারির ভাষায় ‘ইনি মুম্বইয়ের গুগল ছিলেন। এই শহরের এমন সমস্ত খুঁটিনাটির ইতিহাস তিনি জানতেন। মানুষকে শেখাতে তাঁর কখনও কোনও দ্বিধা ছিল না।  সে পিএইচডির গবেষক হোক বা সাধারন ছাত্র তাঁর কাছে সবার অবারিত দ্বার’

মুম্বই-তে তাঁর আলটামাউন্ট রোডের বাড়ির বৈঠকখানাতে দেশ তো বটেই  পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইতিহাস গবেষকরা আসেন।

 ১৯৯০ তে মুম্বই- এ  হেরিটেজ বাঁচাও আন্দোলনের তিনি ছিলেন প্রাণ পুরুষ।  মুম্বই- এর সমস্ত ঐতিহ্যশালী ভবন ও সৌধের মানচিত্র তৈরি করে দিয়েছিলেন ফয় । সেখান থেকে ৯০ টি ভবনকে প্রথম তালিকায় রাখা হইয়েছিল। যেগুলি রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্ব নিয়েছিল সিভিক অথরিটি।

FotoJet (154)

ফয়ের ছাত্রদের ভাষায় আসলে মানুষটি ছিলেন নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। যাকে  ছাড়া এই আন্দোলন কোনভাবেই রূপ পেত না।

ফয়  নিসিন এর অস্ত্র ছিল ক্যামেরা। তাঁর তোলা ফটোগ্রাফ হেরিটেজ রক্ষার ক্ষেত্রে সম্পদ। কিন্তু অনেকের মতেই ফয়  আলোকচিত্রী হিসাবে উপেক্ষিত থেকে গিয়েছেন। তাঁর আলোকচিত্র শিল্পের দিক থেকেও যে কতটা উচ্চমার্গের তার সঠিক মূল্যায়ন হয়নি।

সাদা কালো ফ্রেমে তিনি শুধু মুম্বই নয়, দেশের বিভিন্ন শহরকে ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন। দেশ তাঁকে আলোকচিত্র শিল্পী হিসাবে পরিচিতি না দিলেও অক্সফোর্ড বিশবিদ্যালয়ের মর্ডান মিউজিয়ামে তাঁর বেশ কিছু ছবির প্রদর্শনী হয়েছিল।  নিসিন’স ফটোগ্রাফি নামে একটি গ্যালারিও করা হয়েছিল।

কিন্তু স্বভাব লাজুক, চিরকাল আড়ালে থাকতে চাওয়া মানুষটি কখনই সেভাবে প্রচারের আলোয় আসতে চাননি। কথার চেয়ে কাজকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে এসেছিলেন জীবনে।

অ্যালজাইমার. আক্রান্ত হন শেষ জীবনে। ২০১৮ সালে লোকচক্ষুর অন্তরালে প্রয়াণ ঘটে।  

মৃত্যুর পর মুম্বইতে তাঁর ছবির প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়।

 

 

  

  

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...