আজ রবিকার অবন ঠাকুরের জন্মদিন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ৭ই আগস্ট ১৮৭১ সালে জোঁড়াসাকোর ঠাকুরবাড়িতে। দিনটি ছিল জন্মাষ্টমী। তারপর থেকেই জন্মাষ্টমী তিথিতেই তার জন্মদিন পালন হত। গুনেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সৌদামিনীর পুত্র ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তৃতীয় ভাই গিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৌত্র ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ বংশের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইপো এবং গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইও জোড়াসাঁকোর ব্যতিক্রম ছিলেন না। তিনিও ঠাকুর বাড়ির প্রতি ঐতিহ্য ও নাম-মর্যাদা অক্ষত রেখেছিলেন।
বাংলাকে অখণ্ড রাখতে, রবীন্দ্রনাথের রাখি বন্ধন ও স্বদেশি অন্দোলনের অন্যতম সঙ্গী এবং উদ্যোক্তা অবন ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথের উৎসাহেই লেখালেখির শুরু করেন রবিকার ভাইপো। প্রথমে লিখলেন শকুন্তলা, রবীন্দ্রনাথের প্রশংসা আদায় করলেন। একের পর এক ক্ষীরের পুতুল, রাজকাহিনী, বুড়ো আংলা ইত্যাদি লিখে ফেললেন। জোড়াসাঁকোর ধারে গ্রন্থ অবনীন্দ্রনাথ লিখে গিয়েছেন, “রবিকা বলতেন ‘অবন একটা পাগলা’ সে কথা সত্যি। আমিও এক এক সময় ভাবি, কী জানি কোনদিন হয়ত সত্যি খেপে যাব।...চির কালের খ্যাপা আমি। সেই খ্যাপামি আমার গেল না কোনো কালেই।’
ছেলেবেলায় দুষ্টুমির জন্য বোম্বেটে নাম দেওয়া হয়েছিল। বাড়ির দোতলার বারান্দায় একটা জল ভর্তি টবে কিছু লাল মাছ থাকত। একদিন তার হঠাৎ করেই মনে হয়েছিল লাল মাছ তাই লাল জলে থাকা উচিত। যে মনে হওয়া সেই কাজ, লাল রঙ জোগাড় করে ঢেলে দিয়েছিলেন। পরে মাছগুলি সব মরে ভেসে উঠেছিল। অন্য এক ঘটনা বাড়িতে তখন পাখির খাঁচা তৈরি হচ্ছে। মিস্ত্রিরা খেতে গিয়েছে, এই সুযোগে হাতুড়ি, বাটালি নিয়ে কাঠের উপর মারলেন, বাটালির ঘা পড়ল বাম হাতের বুড়ো আঙুলে, আঙুল চুষতে চুষতে ছুটে পালালেন অবন ঠাকুর।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু ১৮৭৬ সালে নর্মাল স্কুলে। তারপর সংস্কৃত কলেজে পড়লেও, এনট্রান্স পরীক্ষা দেওয়ার আগেই কলেজ ছাড়লেন তিনি। ইংরেজি, ফরাসী, সংস্কৃত ও বাংলা ভাষা সাহিত্যে এবং সংঙ্গীত সব কিছুই শিখেছেন। তবে ছবি আঁকার প্রতি আগ্রহ ছিল প্রবল। লন্ডনে চিত্রশিল্পী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছেন এবং জয়ীও হয়েছেন। আবার ইংরেজ সরকারের থেকে সিআইই উপাধিও পেয়েছেন। সি এল পামারের কাছে অয়েল পেন্টিং শিখেছিলেন। তারপরে জল রঙের কাজ শিখেছিলেন। প্রথম দেশীয় ধরনের ছবি ‘শুক্লাভিসার’ এঁকে তাঁর মন ভরেনি। তাই মনে মনে ঠিক করেছিলেন দেশীয় টেকনিক শেখার কথা। সেই সময় রাজেন্দ্র মল্লিকের বাড়িতে পবন নামের এক মিস্ত্রি ছবির ফ্রেমে সোনা লাগানোর কাজ করত। তাঁর কাছে গিয়ে ছবিতে সোনা লাগানোর পদ্ধতি শিখেছিলেন। এরপরই বৈষ্ণব পদাবলীর এক সেট ছবি এঁকেছিলেন। এর পরে একে একে এঁকেছিলেন কৃষ্ণলীলা, আরব্য রজনী, শাহজাহানের মৃত্যু, নির্বাসিত যক্ষ, ভারতমাতা ইত্যাদি অজস্র ছবি। এমনকি রবিকার শেষ যাত্রার ছবিও।
বেঙ্গল স্কুলের এই পথিকৃতের শিল্পসত্ত্বা তথা শিল্প চেতনা এক নব্যবঙ্গীয় চিত্রকলার রীতির জন্ম দিয়েছিল। যা এ দেশের আধুনিক চিত্রকলার পথ প্রশস্ত করেছিলেন। অসামান্য এক শিক্ষক, এসরাজ বাদক, অভিনেতা। নিজের ব্যক্তিগত জীবনে আটপৌরে, স্নেহশীল, কর্তব্যপরায়ণ এক জন ছিলেন অবন ঠাকুর মানুষ। নিজেকে নিয়ে বলতেন, তার নাকি কর্মজীবন বলে কিছুই নেই, তিনি নাকি অতি নিষ্কর্মা মানুষ। নিজে হতে কোন চেষ্টা ছিল না তার, তবে কেউ খাটিয়ে নিলে খাটতে পারেন এটাই তার আত্মবিশ্লেষণ।
শিশুদের জন্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাঁড়ার অফুরন্ত। শিশুমনের উপযোগী গল্প, কাহিনী, রূপকথা ও রোমাঞ্চ জাতীয় রচনা সৃষ্টিতে তাঁর নতুন রচনার আখ্যাগুলি খুবই মনোহর। ছোট-বড় মিলিয়ে তাঁর রচিত গল্পের সংখ্যা চুরানব্বই। তার রচিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ শকুন্তলা ১৮৯৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। অনুবাদ গ্রন্থ এবং ভাষার রূপের জন্য যা আজও বিখ্যাত। তার দ্বিতীয় গ্রন্থ ক্ষীরের পুতুল ১৮৯৬ সালে প্রকাশিত হয়। ক্ষীরের পুতুল রূপকথাধর্মী রচনা, লোককথা, লোকবিশ্বাস সংস্কার এবং শিশুমনের খেয়ালিপনা স্থান পেয়েছে। একদিকে যেমন শিল্পীর তুলির মাধ্যমে নানা চিত্র অঙ্কন করেছেন তেমনই চমৎকার গদ্য রচনা করেছেন। গল্পগ্রন্থগুলিতে শিশুর কল্পনাপ্রবণতা ও রোমাঞ্চ-রস ছড়িয়ে আছে। অবন ঠাকুরের নিঁখুত কথ্যরীতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও আকৃষ্ট করেছিল। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, 'অবন যেন কথা কইছে আমি শুনতে পাচ্ছি।'
আগেই বলেছি, ঠাকুরবাড়ির প্রথা মেনে জন্মাষ্টমীর দিনই প্রতি বছর তাঁর জন্মদিন পালন করা এই। অবনীন্দ্রনাথের জন্ম তারিখ ৭ আগস্ট। একদা রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছেতে জোড়াসাঁকোর পাঁচ নম্বর বাড়ির দক্ষিণের বারান্দায় শান্তিনিকেতনের কলাভবনের শিক্ষক এবং ছাত্র-ছাত্রীরা মিলে অবনীন্দ্রের জন্ম তিথি পালন করেছিলেন। নন্দলাল বসু, গৌরী ভঞ্জ, রানি চন্দ, বিনায়ক মাসোজি প্রমুখেরা সেখানে ছিলেন। ছাত্র মুকুলচন্দ্র দে প্রতি বছর ৭ আগস্ট জোড়াসাঁকোর বাড়িতে এসে অবনীন্দ্রনাথের জন্মদিন পালন করতেন। কিন্তু ১৯৪১-এর ৭ আগস্ট সব কিছু পাল্টে গিয়েছিল। কারণ ওইদিনই মহাশূন্যের পথে পাড়ি দিয়েছিলেন অবন ঠাকুরের রবিকা।