হেমন্তে ধান্যলক্ষ্মীর আরাধনায় নবান্ন উৎসব

হঠাৎ কোন ‘বাছট’ বা বাধা না-এলে রাঢ়বাংলার বাঁকুড়া-পুরুলিয়া-মেদিনীপুরে অঘ্রান থেকে পৌষ মাসের মধ্যেই নবান্ন উৎসবে ধান্যলক্ষ্মীর পুজো হয়ে যায়। গাঁইগুষ্টির মধ্যে কারও বাড়িতে ছেলেপুলে হলে কিংবা হঠাৎ কেউ মারা গেলে সেটাকেই বলে, ‘বাছট’ বা বাধা। ছেলেমেয়ে জন্মানোর ক্ষেত্রে আঁতুড়শুদ্ধি না-হলে, আর অশৌচের ক্ষেত্রে তেপক্ষ না-পেরোলে পুজো করা যায় না। তখন নবান্ন গড়াতে গড়াতে মাঘ মাসে গিয়ে ঠেকে। সে যাই হোক, পুজোটা হয় কিন্তু বেস্পতিবার ধরে, কারণ, সেটাই লক্ষ্মীর বার।

আশ্বিনে দুগগা পুজোর পর পরই ছিল, 'ডাক পরব' আনুষ্ঠানিকভাবে এই পরবের মধ্য দিয়ে গেরস্ত নারীবেশী পুরুষকে দূত হিসেবে মাঠে পাঠিয়ে ধানের লক্ষ্মীকে বাড়িতে আসার জন্য নেমন্তন্ন করেছিলেন। মা লক্ষ্মী সেই দূত-মারফৎ তাঁর আগমন উপলক্ষে বর্ষায় গজিয়ে ওঠা ঘাস-আগাছা চেঁছে গোবর ছড়া দিয়ে খামার তৈরি এবং মরাই বাঁধার কাছি পাকিয়ে রাখার বার্তা পাঠিয়েছিলেন গেরস্তের কাছে। অঘ্রানের মাঝামাঝি সেই মতো খামার প্রস্তুত করে মাঠের ধান খামারে এনেছেন গেরস্ত ধানের সঙ্গে ধান্যলক্ষীও এসেছেন গেরস্তের দোরগোড়ায়। নবান্ন উৎসবের মধ্য দিয়ে তাঁকেই ঘরে বরণ করবেন তাঁরা। পুজোও করবেন। দেবীর কৃপায় যেহেতু নতুন ধানে তাঁদের খামার ভরেছে, তাই সেই নতুন ধানের নতুন চালের অন্ন-পিঠে-পায়েস গেরস্ত আগে দেবীকে নিবেদন করে তারপর নিজেরা গ্রহণ করবেন। কৃতজ্ঞতা প্রকাশের এই ভাবনা থেকেই গড়ে উঠেছে নবান্ন উৎসবের আধ্যাত্মিক চরিত্র।

পুজোর দিন সকালে বাড়ির কর্তা তিন ধুচুনির মতো নতুন ধান নিজের হাতে ঝাড়েন। আগে ঝাড়তেন ধান ঝাড়ুনি পাটা অর্থাৎ মোটা তক্তায়, এখন মেশিনে, এটাই নিয়ম। তারপর বাড়ির কর্তা কিংবা পুরুতমশাই, যিনিই পুজো করুন না কেন, তিনি স্নান করে সেই ধান ধুচুনিতে ভরে মাথায় তুলে তিনবার নিয়ে আসেন খামার থেকে ঠাকুরঘরে। এই তিনবারই তাঁর সামনে সমানে জলের ধারানি দিয়ে, উলু দিয়ে, শাঁখ বাজিয়ে বাড়ির মেয়েরা সাদরে এই ধানরূপী মা লক্ষ্মীকে খামার থেকে বরণ করে নেন। ঠাকুরঘরের পুব দেওয়াল ঘেঁষে বিঘৎখানেক লম্বায়-আড়ে সেই ধান পুরু করে মেলে দেন পূজারি। তারপর তার চারপাশে আখের খণ্ড ফেলে বেড়া দেন। এটাই দেবীর বেদি

ঠাকুরঘরে আলাদা বেদি বা কুলুঙ্গিতে থাকে দেবী লক্ষ্মীর হাঁড়ি। হাঁড়ির মুখ ঢাকা থাকে সরায়। হাঁড়ির ভেতরে বিগত বছরের বেদির অল্পকিছু ধানের সঙ্গে থাকে কড়ি, ঝিনুক, প্রণামীর আনা-টাকা-কয়েন; আর এসবের সঙ্গেই থাকেন ডোকরা শিল্পীদের বানানো পুরুষানুক্রমে পূজিত পেতলের লক্ষ্মীঠাকুর, লক্ষ্মীপেঁচা এবং লক্ষ্মীনারায়ণে যুগল মূর্তি। হাঁড়ি থেকে বের করে তুলসী তলায় একটি কাঁসার কানা-উঁচু বড় থালায় গাওয়া ঘি ও হলুদ মাখিয়ে দেবদেবীর পেতলের মূর্তি, পেঁচা, কড়ি, ঝিনুক প্রভৃতিকে স্নান করানো হয়। তারপর তাঁদের ভালোভাবে মুছিয়ে বরণ করে মাথায় চাপিয়ে ঘরে তোলা হয়।

ধান ও আখ দিয়ে বানানো বেদিতে একে একে দেবী, প্যাঁচা, কড়ি ও ঝিনুকদের স্থাপন করা হয়। এদিন দেবীর সঙ্গে পূজিত হয় এ-অঞ্চলের শস্য-দুধ ইত্যাদি মাপার প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত একক-আধার-পাই, কনা ও চউঠি। (চার চউঠিতে এক কনা, চার কনায় এক পাই। এক পাই, ওজন মাপে প্রায় এক কেজির কাছাকাছি)। এগুলো প্রকারে দেখতে একেবারে লক্ষ্মীর ঝাঁপির মতো। তাছাড়া ধানরূপী লক্ষ্মী ও পক্ষান্তরে গেরস্তের সমৃদ্ধির পরিমাপের আধার হওয়ার জন্যই হয়তো এগুলো লক্ষ্মীর সঙ্গেই পূজিত হয়। বেদির একেবারে সামনে স্থাপন করা হয় হরতুকি মাথায় চাপানো ধানভরা লক্ষ্মীর ঝাঁপি।

মাঝরাত্তির থেকে উঠে স্নান করে দেবীর জন্য বানানো হয় ভোগ-নৈবেদ্য। আতপের ভাত, পুনকা শাক, ভাজাভুজি, ব্যঞ্জন, অড়হরের ডাল সব মিলিয়ে পাঁচ, সাত বা নয় রকমের পদ, আর তার সঙ্গে আছে নতুন চালের পায়েস, আসকে পিঠে, কাখরা পিঠে, গড়গড়ে পিঠে ও গুড় পিঠে। এসমস্তই বানানো হয় গাওয়া ঘি দিয়ে। মাঝরাত্তিরে শুরু করে এসব বানিয়ে শেষ করতে পুজোর দিনের দুপুর গড়িয়ে যায়। এসব বানান বাড়ির মেয়েবউরাই।

শীতকালে এ উৎসব হলেও, বাতাসে নলেন গুড়ের গন্ধ ম ম করলেও এই উৎসবে তার স্বাদ নেবার কোন উপায় নেই। কারণ, দেবীর ভোগ তৈরিতে নলেন গুড় ব্যবহার করা যায় না। লোকসাধারণের বিশ্বাস, খেঁজুর গাছের গলা কেটে বা জবাই করে যেহেতু রস বের করে এই গুড় তৈরি করা হয়, তাই তা নাকি হিন্দু দেবদেবীদের পুজোয় ব্যবহার করা যায় না। যুক্তিটার মধ্যে গভীর ভাবনা আর দারুণ উদ্ভাবনী ক্ষমতার পরিচয় আছে ঠিকই, কিন্তু প্রকৃত সত্য নেই। আসলে, এ-দেশে আখের রস থেকে গুড় তৈরির ঐতিহ্য অনেক প্রাচীন, তুলনায় খেজুর গাছের রস থেকে নলেন গুড় তৈরির ঐতিহ্য অনেক পরবর্তীকালের। তাই প্রাচীন শাস্ত্রে দেবদেবীর পুজোয় আখের গুড় ব্যবহারের কথাই বলা হয়েছে, নলেন গুড়ের কোন উল্লেখই নেই।

যাই হোক; ভাত, ডাল, পদ, পিঠে, পায়েস-এসব কলাপাতা ও কাঁচা শাল-পলাশ পাতার দোনায় সাজিয়ে দেবীর জন্য ভোগ বাড়া হয়। ভোগ দেওয়া হয় পাঁচ, সাত বা নয়-এমন বিজোড় সংখ্যায়। মাঝখানে থাকে ‘বড় ভোগ’, এতে সব কিছুই বেশি বেশি করে থাকে। পুজোর শেষে এই ভোগপ্রসাদ পাবার অধিকারী হন একমাত্র বাড়ির কর্তা।

দেবীর পুজো হয় শাস্ত্রীয় মন্ত্রে। পুজো করেন পুরুষ। মেয়েরা শুধু লক্ষ্মীর ব্রতকথা পাঠ করেন। বাড়ির সবাই অঞ্জলি দেন। অঞ্জলির সময় দেবীকে প্রণামী দেওয়া টাকা বছর বছর জমিয়ে রেখে দেওয়া হয় লক্ষ্মীর হাঁড়িতে। পরে তাই দিয়ে কেনা হয় ঝিনুক, কড়ি বা দেবীর নতুন ডোকরা মূর্তি।

পুজোর রাতে দেবীর আরতি করে ভোগ নিবেদন করা হয়। বাম পাশে শুইয়ে ঘুম পাড়ানো হয়। পরদিন দেবীকে জাগানোর পর শেতল-নৈবেদ্য নিবেদন করা হয়। রাতে শুইয়ে দেবার আগেও তাই। তিনদিনের দিন সকালে স্নান করে এসে দেবীকে খাইয়ে আবার লক্ষ্মীর হাঁড়ির মধ্যে তুলে রাখা হয়, একে বলে 'ঠাকুর তোলা'। মূল পুজোর পর আর পুরুত বা পুরুষের দরকার পড়ে না। দেবীকে খাওয়ানো, শোয়ানো, জাগানো, হাঁড়িতে তোলা-সবই এয়োরা করেন। আর দেবীকে হাঁড়িতে তুলে দেওয়ার দিন থেকেই আবার যেন শুরু হয়ে যায় বছরভরের অপেক্ষা...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...