আবার সব ছাপিয়ে গুগাবাবায় জাদুকর বরফি ও সোনার কেল্লায় সিধু জ্যাঠা।সোনার কেল্লা ছবিতে সিধু জ্যাঠাকে দেখে মনে প্রথমেই যে প্রশ্নটা এসে পড়তো - ঘরের মধ্যে চোখে কালো চশমা কেন ? এমনকি পেপার কাটিং এর খাতা থেকে হেমাঙ্গ হাজরার খবরটা খুঁজে বের করবার সময়েও চোখ থেকে চশমাটা খোলেননা। গল্পের সিধু জ্যাঠার বর্ণনাতে তো এমন কিছু নেই।
সোনার কেল্লা তৈরির মাত্র দু বছর আগেই ১৯৭২ সালে সত্যজিৎ তৈরি করেছেন তাঁর শান্তিনিকেতনের শিল্পগুরু, দৃষ্টিশক্তিহীন মহাশিল্পী বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে তথ্যচিত্র 'ইনার আই'। ফেলুদার চরিত্রটি যদি আসলে সত্যজিতের নিজের অলটার ইগো হয়ে থাকে , তাহলে কি সিধু জ্যাঠার ভূমিকায় বিনোদবিহারীর চেহারাটাই অবচেতনে তাঁর মাথায় ছিল ?
কারণ সত্যজিতের সঙ্গে বিনোদবিহারীর যে সম্পর্ক , ফেলুদার সঙ্গে সিধুজ্যাঠার সম্পর্কটাও ঠিক একইরকম । আর যিনি পর্দায় সমস্ত রস নিংড়ে ফুটিয়ে তুললেন সেই চরিত্রটাকে, তাঁর পরিচয়ও কোনও বর্ণনার অপেক্ষা রাখেনা। শুধুমাত্র নামটাই যথেষ্ট, হারীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়।
এক কুলীন ব্রাহ্মণ বঙ্গ সন্তান, নিজস্বতার ছাপে রঙিন করেছেন হিন্দি ও ইংরাজী সাহিত্যকে। তাঁর অভিনয় সত্তার আলোকে ঢাকা পড়ে গিয়েছে অন্যান্য উজ্জ্বল প্রতিভারা। বাবা দেশের প্রথম ডক্টরেট ইন সায়েন্স। অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়। মা সুগায়িকা এবং নিয়মিত কবিতা চর্চায় ব্রতী। তিন ভাইবোনের মধ্যে তিনিই ছোট। বড়ো দাদা বীরেন্দ্রণাথ, আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন কমিউনিস্ট বিপ্লবী আর দিদি সরোজিনী নাইডু।
কবি হারীন্দ্রণাথ বিরল, স্বত: স্ফূর্ত, কল্পনা সমৃদ্ধ ও ছন্দোময়। এমনকি বঙ্গ কবির রোমান্টিসিজম এক পাল্লায় স্থান পেয়েছে কিটস ও শেলী যুগলদের সঙ্গে। ১৯৬৬ তে তাঁর লেখা রেল গাড়ি শোনালো আকাশবাণী। রেডিওর এপারে দেশবাসী। কন্ঠে স্বয়ং কবি। এক ছোট্ট শিশুর রেলগাড়ি নিয়ে রোমাঞ্চ ছিল সেই লেখার উপজীব্য। আশীর্বাদ ছবিতে দাদামনি অশোক কুমারের কন্ঠে সেই পাঠ আরও অন্য রূপকে উপনীত হয়েছিল।
তাঁর সনেট কবিতা গুলির ভক্ত ছিলেন বিশ্বকবি। ব্রিটিশ মহলে সাড়া ফেলেছিল তাঁর লিমেরিক। চলচ্চিত্রের গানও বাদ পড়েনি তাঁর কলম থেকে। ঝর্নার গতিতে লিখে ফেলেছেন জুলি ছবির মায় হার্ট ইস বিটিং। সাহিত্য ও বিনোদন জগৎকে আঁকরেই ছিল আনাগোনা। বহুদিন ব্রিটেনে থাকলেও, রক্তে মিশে থাকা বাঙালিয়ানা কে ভোলেননি কখনও।
আর অভিনেতা হারীন্দ্রনাথ কে নিয়ে বিশেষ আলোচনার প্রয়োজন পড়েনা, অন্তত বাঙালির কাছে। ছেলেবেলার ফ্রেমে একে একে দখল করা জায়গা গুলো তো তাঁরই; অভিনয়ের বশে। আর হিন্দি ছবি বাওয়ার্চি তে বাড়ির বুড়ো মালিক এবং বাবাকে না চেনার ভুলটাও অন্তত সিনেমা প্রেমীরা করবেন না। তবুও স্থায়ী হয়নি কমলা দেবীর সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক। মনের অমিল, মতানৈক্য না কি স্বাধীনচেতা স্বভাব, কী হয়েছিল স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের অন্তরায় তা আঁচ করা যায় না। স্বাধীন ভারতের প্রথম আইনি বিবাহ বিচ্ছেদের তকমাটাও তাঁর নামেই রেজিস্টার্ড।
পা রেখেছিলেন দেশীও রাজনীতির টালমাটাল চোরাপাকেও। ১৯৫১ সালে অনুষ্ঠিত হলো স্বাধীন দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন। বিজয়ওয়াড়া লোকসভা কেন্দ্র থেকে কমিউনিস্ট পার্টি সমর্থিত নির্দল প্রার্থী তিনি। আগামী পাঁচ বছর কেটে গেলো প্রথম লোকসভা নির্বাচনের জয়ী প্রার্থী রূপে। ১৮৯৮ এর আজকের দিনে হায়দ্রাবাদ, বর্তমানে তেলেঙ্গানায় এই চির শিশুর ভূ - আগমন। বরফি জাদুকর চাইতেন না কোনওভাবে তাঁর ভিতরের শিশুটার কিছু হোক। সে চুপ হলে, চুপ থাকতে বাধ্য হবেন তিনিও।
তেমনটাই হয়েছিল হয়ত। আসলে শিশুকে একদিন না একদিন তো বড়ো হতেই হতো। তাই জীবনের ছন্দ কাটালেন হরেন চাটুজ্যেও। ১৯৯০ এর ২৩ শে জুন পদ্মবিভূষণ শিশু পাড়ি দিয়েছিল বিশ্ব পিতার নন্দন কাননে। আর ফিরবেন না। এরপরে আসার পালা যে আরও এক কিংবদন্তীর; সিধু জ্যাঠার প্রকৃত রূপকার।মনের বয়স বাড়তে দিতে ছিল ঘোর আপত্তি। ব্যক্তি হরেনও চাইতেন চিরজীবন মনের জানালা খুলে রাখতে।