জেলিফিশ রহস্য

না আছে হৃদয়, না আছে মস্তিষ্ক। অস্থি, রক্ত কিচ্ছু নেই। ডায়নোসরের চেয়েও আগে পৃথিবী দেখেছে সে। জলের মধ্যে বাস, সাপের চেয়েও বেশী বিষাক্ত।

কী বলুন তো তার নাম?  

সমুদ্রের নীল জল। তার মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছে রঙিন জেলি। কোথাও স্থির নেই তারা। জলের তলার দুনিয়ায় হঠাৎ দেখলে জলতল নাকি নভোতল ভেবে ভ্যাবাচাকা খায় মানুষ। তাদের গায়ে হাত ছোঁয়াতে ইচ্ছে করে খুব, কিন্তু খবরদার! ছুঁলেই শিয়রে শমন! 

উজ্জ্বল রঙের তলতলে নরম এই ভেসে বেড়ানো এই জলচর জেলিফিশ। নামের সঙ্গে ‘ফিশ’ মানে ‘মাছ’ থাকলেও আদতে এরা কিন্তু অমেরুদণ্ডী প্রাণী। ঘণ্টাকৃতি জেলীসদৃশ প্রাণীটি প্রাণীজগতের নিডারিয়া পর্বের সিফোজোয়া শ্রেণীর অন্তর্গত। ৫ হাজার কোটি বছর ধরে সাগরে এদের বাস। মহাসাগর থেকে গভীর সমুদ্রতীর অঞ্চল সর্বত্র এদের পাওয়া যায়।

জেলিফিশ মানুষের কাছে জল-পৃথিবীর অন্যতম আকর্ষণ। ম্যাসোগলিয়া নামে এক ধরনের জেলি জাতীয় পদার্থ দিয়ে তৈরী এদের শরীর। তার মধ্যে ৯৫ শতাংশ জল। মানুষের শরীরে থাকে ৬০ শতাংশ জল।শরীরে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র আছে।

জেলিফিশের জীবন কয়েকঘন্টা, কয়েকমাসও হতে পারে। আবার অমর জেলিফিশও আছে। যারা বয়সের কাঁটাকে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দিতে পারে। জীবন জগতে একমাত্র জেলিফিশেরই এই ক্ষমতা আছে।

টারিটোপসিস ডোরনি প্রজাতির জেলিফিশের শরীরের কোনও অংশে আঘাত লাগে, বা অসুস্থ হয়ে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে এরা ‘পলিপ দশা’-এ চলে যায়। নিজের চারপাশে মিউকাস মেমব্রেন তৈরি করে গুটি বাঁধে পলিপের আকারে। এই পলিপ অবস্থায় এরা তিন দিন পর্যন্ত থাকে। শরীরের সব কোষকে নতুন কোষে রূপান্তর করে। আর এ ভাবেই বয়সের কাঁটা দেয় থামিয়ে।

রাতের সমুদ্রে উজ্জ্বল রঙের জেলিফিশ বড় মায়াবী। মাঝ সমুদ্রের মোহিনী মায়া বা চোখের ভুল নয়, জেলিফিশের শরীরে বায়োলুমিনেসেন্ট অঙ্গ আছে, তার মাধ্যমেই শরীর থেকে সবুজ, নীল ফ্লুরোসেন্ট আলো ঝরাতে সক্ষম হয় এরা।

নানারকম আকারের জেলিফিশ হয়। এখনও পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে বড় জেলিফিশটির আকার ১২০ ফুট। ম্যাসাচুসেটসে পাওয়া গিয়েছিল। জেলিফিশের খাবার ছোট মাছ, স্রিম্প, জলজ শ্যাওলা। হজমক্ষমতা অত্যন্ত শক্তিশালী।   

জেলিফিশের চকচকে রং আর অদ্ভুত আকার যতই আকর্ষণ করুক, কয়েক প্রজাতির জেলিফিশ বেশ ভয়ঙ্কর। যে কারণে তাদের ‘বক্স অফ ডেথ’ বলা হয়। জেলিফিশ লম্বা কর্ষিকা দিয়ে নেমাটোসিস্ট ও বিষ বহন করে। হুল এতটাই বিষাক্ত যে সাপের বিষকেও হার মানায়। মাত্র চার মিনিটের মধ্যে শিকারকে প্রাণে শেষ করার ক্ষমতা রাখে এরা। সমুদ্র স্নানে আসা মানুষদের কাছে জেলিফিশ আতঙ্কের কারণ হয়ে ওঠার নজির কম নেই। জেলিফিশ প্রজাতির মধ্যে অস্ট্রেলিয়ান বক্স জেলিফিশ সবচেয়ে বিপদজনক। চোখের নিমিষে প্যারালেসিস, কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে এদের বিষাক্ত হুলের আক্রমণে।

চীনে আবার প্রাচীন চিকিৎসায় জেলিফিশ ব্যবহৃত হত।     

২০১৪ সাল থেকে ৩ নভেম্বর দিনটি গোটা পৃথিবী জুড়ে ‘জেলি ফিশ’ দিবস হিসেবে পালিত হয়। দক্ষিণ গোলার্ধে এই সময় বসন্ত শুরু হলে জেলিফিশের দল উত্তরের সমুদ্ররেখায় পাড়ি দেয়।

জলতলের বাস্তুতন্ত্রের ভারসামাই বজায় রাখতে জেলিফিশের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সে ব্যাপারে সচেতনতা গড়ে তুলতেই আজকের দিনটি পালিত হয়।

ভারতে প্রায় ৫০ প্রজাতির জেলিফিশ মেলে। ২০১৪ সালে মেরিন বায়োলজিস্টরা গুজরাটে জেলিফিশ লেকের সন্ধান পেয়েছেন। এটিই ভারতের প্রথম এবং এখনও পর্যন্ত পাওয়া একমাত্র জেলিফিশ লেক। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপদেশ পালাওয়ের জেলিফিশ লেক পৃথিবী বিখ্যাত। বহু পর্যটক এখানে বেড়াতে আসেন শুধুমাত্র এই লেকটি দেখার জন্য। ১২ হাজার বছরের পুরনো ১০০ ফুট গভীর এই লেকে পর্যটকরা সাঁতার কাটতে পারেন।

জেলিফিশরা সূর্যের আলো অনুযায়ী তাদের অবস্থান বদলায়। লেকের একেবারে মাঝখানে গেলে কাছ থেকে সোনালী জেলিফিশ দেখা যায়। ২০০১ মুন জেলিফিশের দেখা মেলে। তবে উষ্ণায়ণের কারণে জেলিফিশ লেকে জেলিফিশের সংখ্যা কমতে শুরু করেছিল কয়েকবছর ধরে।

তথ্যসূত্রঃ ন্যাশানাল জিওগ্রাফিক

বায়োলজি ডিকশনারি

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...