দক্ষিণ কলকাতার টালিগঞ্জে ঠাকুমার বাড়ি। উত্তর কলকাতার বিবেকানন্দ রোডে মামার বাড়ির।জন্ম লন্ডনে। বেড়ে ওঠা আমেরিকায়। এখন নিবাস ইতালী। মাছের কাঁটা ছাড়িয়ে খেতে পারেন। ভাত খান আঙুল দিয়েই। কথা বলেন পরিষ্কার বাংলায়। লেখার ভাষা ইংরেজি এবং ইতালিয়ান।
এই পর্যন্ত জানলে সংশয় বাড়ে বাঙালি পাঠকের। কুইজের আসরে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে নাকাল হতে হয়।
এমন ভুবনমুখী জীবন যাঁর, তিনি এক বাঙালি কন্যে। নাম নীলাঞ্জনা সুদেষ্ণা লাহিড়ী। যদিও পৃথিবীর কাছে পরিচিত হয়েছেন ডাক নাম ভালোবেসে। ‘ঝুম্পা লাহিড়ী।
আটপৌরে কলকাতার অভিবাসী মনকে যিনি বিশ্বের পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন অন্য দেখার চোখ দিয়ে।
ঝুম্পা লাহিড়ীর জন্ম লন্ডনে। বেড়ে ওঠা রড আইল্যান্ডে। বার্নার্ড কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর ভর্তি হন বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইংরেজি সাহিত্য, তুলনামূলক সাহিত্য এবং ক্রিয়েটিভ রাইটিং এই তিন বিষয়ে স্নাতকোত্তর। গবেষণার বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন রেনেসাঁ যুগের সাহিত্য।
প্রথম বই ‘ইন্টারপ্রেটার অফ মালাডিস’। ২০০০ সালে পুলিৎজার পায়। ২০০৩ সালে ‘দ্য নেমসেক’। এই বই সাড়া ফেলেছিল বিশ্ব সাহিত্যের দরবারে। সেই উপন্যাসকে চলচ্চিত্রে রূপ দিয়েছিলেন মীরা নায়ার।
ঝুম্পার গল্পে বারবার ফিরে আসে কলকাতা। ব্যক্তিজীবনে রাজনৈতিক-সামাজিক সংকট, ঘাত, প্রতিঘাত। অভিবাসী জীবনের সাংস্কৃতিক টানাপোড়েন। প্রজন্ম সংঘাত চরিত্র হয়ে ওঠে উপন্যাসের। সঙ্গে মিলেমিশে যায় সম্পর্কের ভাঙাগড়া। কাহিনি উঠে আসে চোখে দেখা জীবন থেকে। সেভাবেই নিজের শিকড়কে বারবার ছুঁয়ে যান।
লেখা নিয়ে, ভাষা নিয়ে, পল্ট নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে ভালোবাসেন ঝুম্পা। ব্যক্তিগত জীবনেও সেই স্রোত অবিচল। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ হওয়ার পর নিউইয়র্ক আসতে আর ভালোবাসতেন না। সাহিত্যের জগতের ‘নিয়ম কানুন’ পরিচতি কিছুটা বদ্ধ লাগত বোধহয়। কিন্তু ভিন্ন শহর, ভিন্ন সংস্কৃতি তাঁর সব সময়ের পছন্দ। তাই শুধু ভৌগোলিক অভিজ্ঞতার স্বাদ নিতে পরিবার সমেত উড়ে গিয়েছিলেন ইতালি। প্রিয় শহর রোমে। একেবারে অচেনা শহর, অজানা ভাষা, আধচেনা সংস্কৃতি। পর্যটকের চোখ নিয়ে শহরের পুরনো গন্ধ খুঁজে বেড়ান। সেই খোঁজে কীভাবে যেন মিলেমিশে গিয়েছিল তাঁর নিজের শিকড়ের শহর। কলকাতা আর রোম কখন যেন এক। রোমের বাতাসে কলকাতার গন্ধ তাঁকে অন্য সফরের হদিস দিয়েছিল। তারই ফসল ‘ইন আদার ওয়ার্ল্ড’। ইতালিয়ান ভাষায় লেখা সম্পূর্ণ উপন্যাস।
ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতিতে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা আর নিজের শহরের শিকড়ের টানকে ফিরে ফিরে অনুভব-এই দুই দিক ঘুরে ফিরে আসে ঝুম্পার উপন্যাসে। অভিবাসী জীবনের ওঠাপড়ার সংকট তাঁর উপন্যাসের চেনা বৈশিষ্ট্য। কিন্তু কলকাতা তাঁর কলমে যেভাবে ধরা তা এক আশ্চর্য আখ্যান। লেখার মধ্যে দিয়েই বারবার বাবা-মা আর প্রিয় মানুষের শহরে ফিরে আসা। সেখানেই আজন্মের টান।