উচ্চতায় গড়পড়তা নায়িকার থেকে অনেকটাই কমে। ছোটখাটো সাধারণ চেহারা।ধারালো নাক। পাতলা ঠোঁট। মুখে মেকআপের লেস মাত্র নেই। তবে মেধার ধার আর পরিশীলিত রুচির স্নিগ্ধতা আলাদা করে চোখ টেনে নেয়। টানটান করে বাঁধা লম্বা বেণী তাঁর বাহুল্যহীন চেহারায় যেন আলাদা মাত্রা যোগ করেছে। শুরু থেকেই তিনি অন্যরকম। পর্দা দাপানো অভিনেত্রী। ঝরঝরে আত্মবিশ্বাস সারাক্ষণ বুঝিয়ে দেয়, সঙ্গে যেই থাক স্ক্রিনটা কিন্তু তাঁরই।
বাবার পরিচয়, স্বামীর পরিচয়, সন্তান কিংবা পরিবারের পরিচয় কোনটাই ছাপিয়ে যেতে পারেনি তাঁকে। নিজেই নিজের ব্র্যান্ড বানিয়েছেন তিনি। জয়া ভাদুড়ি। পরবর্তীতে জয়া বচ্চন। জন্ম ভূপালে। প্রবাসী বাঙালি। বাবা তরুণ ভাদুড়ি পেশায় সাংবাদিক, লেখক। আর পাঁচটা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে খুব একটা আলাদা নয়। পড়াশোনাও ভুপালেই। বোর্ডিং স্কুলে পড়তেন। শুরু থেকেই হেড গার্ল। এনসিসিতে ভারত সেরা হয়েছিলেন।
তবে অভিনয়ের দুনিয়ায় পা রাখাটা বেশ নাটকীয়ভাবেই।
সেবার বাবার সঙ্গে পুরী বেড়াতে এসেছিলেন জয়া। বেশ ক'দিন ছিলেন। বিচে গিয়ে দেখেন একটা বাংলা ছবির শুটিং চলছে। ছবির নাম 'নির্জন সৈকতে'। পরিচালক তপন সিনহা। বাবার বন্ধু ছিলেন। এদিকে প্ৰচন্ড বৃষ্টি শুরু। বন্ধ শ্যুটিং । জমে উঠল আড্ডা। বাবার সঙ্গে সঙ্গে থাকতেন জয়া। ছবির টিমের সদস্যদের সঙ্গে আলাপ জমে উঠতে সময় নিল না। সেই দলে ছিলেন রবি ঘোষ, শর্মিলা ঠাকুর।
শুটিং শেষ হতেই টিম কলকাতায়। জয়াও নিজের শহরে।
এদিকে সত্যজিৎ রায় তখন ' মহানগর' ছবির জন্য মুখ খুঁজছেন। দেখা হল নির্জন সৈকতের টিমের সঙ্গে। জয়ার কথায়, " ওরা মানিক কাকুকে গিয়ে বলল, " আপনি মহানগরে'র জন্য মেয়ে খুঁজছেন? 'উই হ্যাভ আ গার্ল'। উনি বললেন, ' দেখাও'। ব্যাস হয়ে গেল। সালটা ১৯৬৩। জয়ার বয়স তখন ১৫। মুখোমুখি হলেন ক্যামেরার। ব্যাক সাইডে সত্যজিৎ রায়। মন লেগে গেল সিনেমায়। সেই টানেই ভর্তি হলেন পুণে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে। পড়া শেষ করে আবার ফিরে এলেন ছবির জগতে। এবার বোম্বাইয়ের মায়া নগরীতে। সত্তরের সিনেমার ঝলমলে দুনিয়ায় জয়া ভারী অন্যরকম। একেবারে যেন বাড়ির পাশের বারান্দা বা ছাদে খানিক আগে আপনি দেখে এসেছেন যাকে। ঠিক তেমনটা। জরি, চুমকি, রাজবেশ ছাড়া স্নিগ্ধ, ঝরঝরে, উচ্ছল।
যে সময়ে অভিনয় শুরু করেন তখন হিরোইন বললেই টানা চোখ, পান-পাতা মুখ, ফর্সা চেহারার চমক মনে করত সাধারণ দর্শক। নায়িকা মানেই উপচে পড়া গ্ল্যামারের স্বপ্ন সুন্দরী। সে ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকা আংশিক 'দেবী' আংশিক 'মানবী'। কিন্তু জয়া রাতারাতি বদলে দিয়েছিলেন দর্শকদের 'নায়িকা' চেনার এই প্যাটার্ন। ১৯৭১-এ হৃষিকেশ মুখার্জি 'গুড্ডি'র জন্য বেছে নিয়েছিলেন তাঁকে। বিপরীতে ধর্মেন্দ্র। পরবর্তী সময়ে মিলি, পরিচয়, বাবুর্চি, কৌশিশ, অভিমান, উপহার। কাজ করেছেন গুলজার, বাসু চ্যাটার্জীর সঙ্গে। অন্য রকম সে সব সিনেমায় মধ্য বিত্ত ভারতের প্রতি দিনের বেঁচে থাকা ধরা দিত লাগল। ১০-৫ টা ডিউটি । যাদের অল্প যায় কিন্তু স্বপ্ন দেখে দিন বদলে যাওয়ার।
টানা অভিনয় করেছেন জয়া। ' অর্ডিনারী'র মধ্যেও যে কতখানি সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে , তার যে কী অভিঘাত হতে পারে দেখিয়ে দিয়েছিলেন সিনেমার ফ্রেমে ফ্রেমে। ম্যানারিজম ছাড়াও সিনেমা হয়। বক্স অফিসে নিজের আলাদা জায়গা করে নিয়েছিলেন। বিপরীতে যেই থাক শুধুমাত্র তাঁকে দেখার জন্যও অপেক্ষা করে থাকবে দর্শক। সঞ্জীব কুমারের বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন 'কৌশিস' ছবিতে। মূক বধির দম্পতি ছবির কেন্দ্রীয় ভূমিকায়। ছবিতে তাঁদের কোনও ডায়লগ নেই, কেবল এক্সপ্রেশন। বদলে দিয়েছিল ছবির ভাষা।
কনভেন্ট স্কুলের ছটফট মেয়েটার ডাকবুকো স্বভাব চাপা থাকেনি পর্দায়।
আবার সেই মেয়েই যখন "শোলে' ছবিতে রাধার ভূমিকায় সামনে এলেন তখন বাকহীন হয়ে গেল দর্শক। থমথমে গ্রামে জুড়ে ভয়ের চাদর। ত্রাসে আতঙ্কে আলোহীন। কোঠাবাড়ির বাড়ির বারান্দায় প্রতিদিন একা একা কুপি জ্বেলে যায় রাধা। সাদা থানে, নির্বাক, বিষাদ প্রতিমা। মাউথ অর্গানের সুর বুক খাঁ খাঁ করে কেঁদে ওঠে। বেদনায় ধূসর সন্ধে। জমাট কান্নার এমন জ্যান্ত পোট্রেট হতে পারে ভারতীয় সিনেমার জানা ছিল না। ডি গ্ল্যাম অন্য ধারার সিনেমার সঙ্গে মেইন স্ট্রিম করেছেন। জঞ্জির, অভিমান, সিলসিলার মতো ছবিতে।
ফিল্ম স্কুলে গোল্ড মেডেল পাওয়া ছাত্রী যখন কেরিয়ারের মধ্য গগণে তখন হেলায় ছেড়ে গিয়েছিলেন সিলভার স্ক্রিন। স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছিলেন অন্দর মহলকে।
১৬ বছর পর ফিরে এসেছিলেন। তপন সিনহা আর গোবিন্দ নিহালনীর ছবি দিয়ে। 'অভাগীর স্বর্গ'। আর হাজার চৌরাশির মা। বাংলা ছবিতেও দেখা গিয়েছে তাঁকে। সংখ্যায় কম। কিন্তু দর্শকরা আজও একই রকম মুগধতা খুঁজে পায় সেই সব সাদাকালো ফ্রেমের জৌলুসে।