জমাট অভিমানটা গলে পড়ার আগেই খানিক তাত পুইয়ে নেওয়া। আগুনে আঙ্গুল রেখে যেন বোঝার চেষ্টা কতখানি দহন যুঝতে পারবে সে। কিংবা কেমন হয় ফুরিয়ে যাওয়ার পথ। শরীর কী করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায় তা সে জানে। তার পূর্বাভাষটুকুই চেনা কিন্তু তার পরের পর্ব সে জানে না। কেমন হয় দহন মুহূর্ত। যে দহনে সে পুড়ছে তার চেয়ে বেশি না কম।
মোমবাতির আগুনে আঙ্গুল ছোঁয়ায়। বেশিক্ষণ সইতে পারে না তার। আঙুল সরে আসে আপনা থেকেই। বদলে যায় ফ্রেম।
এভাবেই মৃত্যুর প্রস্তুতি নিচ্ছিল অদিতি। ভাবলেশহীন মুখ। শুধু চশমার কাচে ঢাকা চোখগুলো আশ্চর্য দীঘি। একটু ঢেউ উঠলেই উপচে পড়বে জল। মোমবাতির শিখা কাঁপতে থাকে। টেবিলের ওপর রাখা ক্যালেন্ডারটায় জ্বলজ্বল করছে তারিখ। আজ ১৯ এপ্রিল। বাবার মৃত্যুদিন। হতেই পারত তারও। কিন্তু গল্প অন্য দিকে মোড় নেয়।
অদিতি সবে পাশ করা ডাক্তার। আর কিছুদিন পরেই প্র্যাকটিস শুরু করবে। তার মা সরোজিনী বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী। জাতীয় পুরস্কারের জন্য সদ্য নাম ঘোষণা হয়েছে তাঁর।
নিঝুম বাড়িতে শুধু ঘুঙুরের আওয়াজ পায় সে। গোটা বাড়ি জুড়ে নৃত্যের ব্যস্ততা। কে যেন একমনে বোল বলে চলে। এই সুর অসহ্য লাগে অদিতির। কান সরিয়ে বাঁচতে চায়। পারে না। কেউ জানে না একদিন সে কতটা ভালোবাসত এই সুর...
সে সব আজ ফিকে। সব হারিয়েছে দূরের সীমায়। আগুনের দাগে আর ভিনদেশি জীবন চাকায়...
উনিশে এপ্রিল অদিতির। ১৯ এপ্রিল ‘দেবশ্রী’র। দেবশ্রী নয়, আসলে দেবশ্রী রায়ের। একটা সিনেমা, একটা চরিত্র কীভাবে রাতারাতি মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে গোটা অভিনয় জীবনের এই ছবি যেন তারই উদাহরণ।
পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের পরিচালনায় ১৯৯৮ সালে মুক্তি পেয়েছিল উনিশে এপ্রিল। ২০২২-এ সেই ছবি ২৮ বছর পার করল। মা-মেয়ের সম্পর্কের টানাপোড়েন আর পেট্রিয়ার্কি সোসাইটির রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গীর দিক নিয়ে ছবি। প্রধান চরিত্রে দেবশ্রী রায় আর অপর্ণা সেন। অপর্ণা সেন মা সরোজিনী। দেবশ্রী রায় মেয়ে অদিতির ভূমিকায়। ডাকনাম মিঠু।
অপর্ণাকে একভাবে চিনতেন বাঙালি দর্শক। উনিশে এপ্রিলের ‘সরোজিনী’কে দেখে তাই তারা খুব একটা অবাক হয়নি। কিন্তু চমকে ছিল মেয়ে অদিতিকে দেখে। কারণ দেবশ্রী রায়কে এর আগে কখনও দর্শক এই ভাবে দেখেনি।
গ্ল্যামার ঝকঝকে নায়িকা চরিত্র থেকে বহু দূরে সে যেন পাশের বাড়ির মেয়ে। চশমা আঁটা বইমুখের মেডিকেল পড়ুয়া। ছবির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অচেনা দেবশ্রী। এক্সপ্রেশন তাঁর অলংকার। টালিগঞ্জের নাচ-গান-অ্যাকশনের মশলাদার বাণিজ্যিক ছবির চকচকে নায়িকা মুখকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। নিজেকে ভেঙে সম্পূর্ণ নতুন হয়ে ধরা দিয়েছেন পর্দায়। পুরোপুরি ‘ডিরেক্টর্স অ্যাকট্রেস’। অদিতি কোনও ছবির চরিত্র নয়, সে ভীষণভাবে রক্তমাংসের মানবী।
অথচ এ ছবির আগে বাংলা ছবির দুনিয়ায় সদ্য পা রাখা পরিচালক ঋতুপর্ণকে সেভাবে চিনতেন না দেবশ্রী। আলাপ এক বিয়েবাড়িতে। তখন সবে উনিশে এপ্রিলের পরিকল্পনা শুরু করেছেন ঋতুপর্ণ। দেবশ্রী তখন নামী তারকা। নতুন পরিচালকের কথা শুনে বলেছিলেন চিত্রনাট্য শুনতে চান।
স্ক্রিপ্ট শুনে এক কথায় রাজী হয়ে গিয়েছিলেন। পারিশ্রমিক নিয়ে এতটুকু মাথা ঘামাননি। উনিশে এপ্রিলের শ্যুটিংও ভীষণ ঘটনাবহুল।
মুক্তির পর মুগ্ধ হয়েছিল দর্শকরা। শুধু সিনেমা ঘিরে সেই মুগ্ধতা নয়, মুগ্ধতা ছিল অদিতিকে ঘিরেও। সেই মুগ্ধতা রেশ ছড়িয়েছিল জাতীয় পুরস্কারের মঞ্চেও। ৩৪৫টি ছবির মধ্যে সেরা হয়েছিল উনিশে এপ্রিল। স্বর্ণকমল সম্মান পেয়েছিলেন দেবশ্রী রায়।
আসলে দেবশ্রী শুধু পুরস্কারের নয়, তাঁর পরিচয় তিনি বাঙালি দর্শকদের ঘরের মেয়ে। ভীষণভাবে এক বাঙালি কন্যে। পানপাতা মুখ, তেল দেওয়া চুলে দুই বেণী। কপালে ছোট্ট টিপ। বুকের কাছে বইখাতা গালে যে মেয়ে রোজ সকাল হলে বাড়ির সামনের রাস্তাটা দিয়ে কলেজ চলে যায়। প্রেমে পড়ে হিসেব কষে না। উড়োনচন্ডী প্রেমিককে প্রশ্রয় দেয় চাকরি ছাড়ার। ময়দানের খোলা হাওয়া ছুঁয়ে যায় তার চুল। ঘাস ছুঁয়ে দেয় পায়ের পাতা। উদাসী হাওয়ায় স্বপ্ন দেখে এই শহরে ঘর বাঁধার…
সেই স্বপ্নের কোনও বিভাজন নেই। শহর-গাঁ-মফস্বলের কালো অন্ধকার ঢাকা পর্দা থেকে আলো উপচে আসে। দর্শকদের চোখ ভরে ওঠে আবেগে। তাদের কাছে আজও ‘দেবশ্রী’ এই নামটুকুই যথেষ্ট…