৯৩-এর এপ্রিল মাসে এয়ারলাইন্স কাপে বাংলাদেশের ভিক্টোরিয়ার বিপক্ষে শ্যামল ঘোষ খেলার শেষ দিকে পরিবর্ত হিসাবে নামালেনধপধপে ফর্সা রোগা একটা বাচ্চা ছেলেকে। কতই বা বয়স ছেলেটার! বছর ষোলো হবে। গ্যালারিতে বসে দর্শক বলাবলি করছে এই বাচ্চাটা কে? কিছুক্ষন বাদে হঠাৎই ডানদিক থেকে একটা বল ধরে ভেতরে কাট করে এসে বাঁ পায়ের একটা ভলিতে দুর্দান্ত গোল করে যেন বলে দিয়ে গেল, 'আমি এসে গিয়েছি। ভারতের সর্বকালের সেরা স্ট্রাইকার। আমি ভাইচুং ভুটিয়া, পাহাড়ি বিছে'।
পরের দিন ইস্টবেঙ্গলের সবার প্রিয় পল্টুদা বলেছিলেন "ওদের চিমা বিজয়ন আছে তো কি হয়েছে আমাদেরও বাইচুং আছে"। পল্টুদার জহুরির চোখ তাঁকে চিনতে ভুল করে নি। তারপর থেকে কতবার ক্লাব ইস্টবেঙ্গল ও দেশকে ভাইচুং গর্বিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে তার কোনও ইয়ত্তা নেই।
দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর প্রায় একার কাঁধে বয়ে নিয়ে গিয়েছে তাঁর প্রিয় লাল হলুদকে। বেশিরভাগ সময়ই মনের মতো স্ট্রাইকিং পার্টনার পাননি, তাও তাঁকে রোখা যায় নি। গোল হয়নি, খেলা প্রায় শেষ লগ্নে, তাও নিশ্চিন্ত থাকত তাঁর সমর্থকরা। গোল হয়ে যাবে ঠিক, বাইচুং আছে যে। ডায়মন্ড দর্পচূর্ণ থেকে গর্বের আশিয়ান কতবার যে ভক্তদের গর্বিত করেছেন তিনি তা গুনে শেষ করা যায় না।
বড় ম্যাচেই তাঁর উনিশটি গোল আছে যার অর্ধেকেও একমাত্র মহম্মদ হাবিব ( দশটি গোল ) বাদে আর কারও নেই। ভাইচুং কেমন প্লেয়ার? সহজ কথাটা স্বর্গীয় অমল দত্ত বলে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, "বিপক্ষের কোচ হিসাবে বার বার ওকে ব্যঙ্গ করেছি। কিন্তু আমার দেখা সেরা ভারতীয় দলে স্ট্রাইকার হিসাবে বাইচুং থাকবেই। পিছনে ভালো ফিডার পেলে ও তছনছ করে দিতে পারে যে কোনো ডিফেন্স"।
খেলা ছাড়ার পর তাঁর বিভিন্ন রাজনৈতিক কাজ নিয়ে অনেকেই সমালোচনা করেছেন, আসলে ভক্তরা মেনে নিতে পারে নি। তাঁকে তো গোল মেশিন হিসাবেই দেখতে চেয়েছে। তাই প্লেয়ার বাইচুং মানেই আজও আবেগে ভিজে আসা চোখের পাতা।
১৯৯৫ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে নেহেরু কাপে উজবেকিস্তানের বিরুদ্ধে ম্যাচে প্রথম বার দেশের জার্সি গায়ে দিয়েছিলেন তিনি৷ তারপর থেকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি।
বাইচুং ভুটিয়ার জন্ম হয় ভারতের সিকিম রাজ্যের টিনকিটামে। তার পড়াশোনা আরম্ভ হয় পূর্ব সিকিমের পাকিয়ঙের সেন্ট জেভিয়ার্স বিদ্যালয়ে। তিনি এরপর স্পোর্টস অথরিট অফ ইন্ডিয়ার স্কলারশিপ পান এবং গ্যাংটকের তাসি নামগ্যাল অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হন। তিনি সিকিমে অনেকগুলি বিদ্যালয় এবং স্থানীয় ক্লাবের হয়ে খেলেন। ১৯৯২ সালের সুব্রত কাপে তার খেলা তাকে বড় ক্রীড়া প্রতিষ্ঠানগুলির নজরে আনে।
১৯৯৩ সালে ষোলো বছর বয়েসে তিনি বিদ্যালয় ত্যাগ করেন এবং পেশাদারী ভাবে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে যোগ দেন। ১৯৯৫ সালে তিনি ফাগোয়ারার জেসিটি মিলসে যোগ দেন। এই ক্লাবটি সে বছর জাতীয় ফুটবল লিগ জেতে। বাইচুং সেই বছরে জাতীয় লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন এবং নেহরু কাপে খেলার জন্য নির্বাচিত হন। তিনি '১৯৯৬ ইন্ডিয়ান প্লেয়ার অফ দ্য ইয়ার' নির্বাচিত হন। এবং তার পর থেকে আরো বহু পুরস্কার তিনি জয় করেছেন। তারমধ্যে রয়েছে ২০০২ এলজি কাপ, ২০০৫ সাফ কাপ, ২০০৭ ওএনজিসি কাপ, ২০০৮ এএফসি কাপ।
১৯৯৯ সালে ভারতীয় ফুটবলার হিসেবে ইউরোপে পেশাদারি ফুটবল জগতে প্রবেশ করেছিলেন তিনি৷ ইংল্যান্ডের বারি ক্লাবের সঙ্গে ৩ বছরের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন তিনি৷ ইউনাইটেড সিকিম এফ সি ফুটবল ক্লাবের যৌথ মালিক ও অন্যতম খেলোয়াড় ছিলেন তিনি। স্বীকৃতিও কম পান নি৷ পদ্মশ্রী ও অর্জুন পুরস্কার পেয়েছেন৷ ক্রিকেট-পাগল ভারতে ফুটবলকে জনপ্রিয় করে তুলতে তাঁর অবদান কম নয়৷ আডিডাস ও নাইকি'র মতো কোম্পানির বিজ্ঞাপনেও তাঁকে দেখা গেছে৷ শুধু ভারত নয়, দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে বাইচুং'এর অনুরাগীদের সংখ্যা কম নয়। তবে
ভরা যুবভারতী। ঘামে ভেজা ফর্সা শরীরে লাল হলুদ জার্সি লেপ্টে থাকা এক তরুণ দু হাত প্রসারিত করে মুক্তির আশ্বাস দিতে দিতে ছুটে আসছেন গ্যালারির দিকে। কানায় কানায় পূর্ণ যুবভারতীর এ মাথা থেকে ও মাথায় ধীরে ধীরে একটা আওয়াজ ক্রমশ গর্জনে পরিণত হচ্ছে "বাইচুং বাইচুং"। অনেকটা সচিন সচিনের মতো শুনতে লাগছে কী ? তিনি তো ভারতীয় ফুটবলের এমনই এক কিংবদন্তী বটে।