“ কাঠমান্ডুর দরবার স্কোয়ারে হাঁটছিলাম। অপূর্ব মন্দির দেখে চোখ মনে ভরে গিয়েছে ততক্ষণে। হঠাৎ একজনকে দেখে চোখ থমকালো। গায়ে রঙচঙে জামা। চোখে সেই ট্রেডমার্ক সানগ্লাস, সামনেই একটা ক্যাফেটেরিয়ায় দাঁড়িয়ে। কাছে যেতেই চমক! আরেহ! পঞ্চম যে!
আমাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলে। কানে হেডফোন। এতক্ষণ তাতেই ডুবে ছিল। আমার দিকে বাড়িয়ে বলল, ‘ আশাজী শুনে দেখুন!’
একটা রেকর্ড শুনছিল ও। একেবারে অন্যরকম!
আমার ছুটি ফুরতে আবার বম্বে। চেনা জগৎ। ব্যস্ত জীবন। মনেই নেই কিছু।
এক দেড় মাস পর একটা ফোন পেলাম। ও প্রান্তে পঞ্চম। তার একটা গান রেকর্ড করতে হবে আমায়। রাজী হয়ে গেলাম এক কথায়।
অসাধারন গান! অসামান্য সুর।পঞ্চম মহাখুশী। তবে খুব চেনা চেনা লাগল। এই মেলডিটাই তো কাঠমান্ডুর রাস্তায় হঠাৎ দেখায় শুনিয়েছিল পঞ্চম!
রেকর্ডিং-এর দু’দিন পর ফের পঞ্চমের ফোন। সেই খুশি ভাব টা বেমালুম যেন গায়েব হয়ে গিয়েছে তার। থমথমে গলায় জানালো। সেদিন রেকর্ড করে আসা গান খানা বাদ দেওয়া হয়েছে ছবি থেকে। বাজ পড়ল যেন! খুব মন খারাপ।
নাহ! গান বাতিলের খবরে মন খারাপ নিয়ে বাড়িতে বসে থাকেননি আশাজী। আপনাদের আশা ভোঁসলে। ছুটে গিয়েছিলেন ছবির পরিচালক দেব আনন্দের বাড়ি।
দেব সাবকে সরাসরি বলেছিলেন, কিছুতেই বাতিল করা যাবে না এই গান। যে কোন উপায়ে ফিরিয়ে আনতে হবে।
দেব আনন্দ মেনে নিয়েছিলেন তাঁর কথা।
কিন্তু গান নিয়ে গণ্ডগোলের গেরো এত তাড়াতাড়ি খুলল না। অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর খড়গ নেমে এল গানের ওপর। রেডিয়োয় ব্যান হল গান।
ভাগ্যক্রমে রাজী হল রেডিয়ো সিলন। সেখানেই মিলল ছাড়পত্র। এয়ার হতেই রাতারাতি হিট!
‘দম মারো দম’ এর সুর ছড়িয়ে পড়তেই সেই গানের নেশায় বুঁদ গোটা দেশ। ক্রেজ এতটাই যে ‘ বিনাকা গীতমালা’র রেটিং-এ পাকাপাকি এক নম্বরে জায়গা করে নিল প্রায় ‘বাতিল গান’টা।
সেই ট্র্যাডিশন এখনও চলছে। ‘এভারগ্রিন’ আশার ‘এভারগ্রিন’ গানগুলো আজও একই রকম পাগল করে মানুষকে। টগবগে এনার্জিতে শিরায় শিরায় সুরের ক্ষ্যাপামি।
সকাল থেকে সন্ধে হয়ে মধ্যরাত যে কোনও সময়, যে কোনও মুহূর্তে তাঁর গান মায়াজালে বাঁধতে পারে শ্রোতাকে।
১৮ টি ভাষায় গান গেয়েছেন ২০ হাজারের ওপর। ওপি নায়ার থেকে শুরু করে রাহুল দেব বর্মন যে সঙ্গীত পরিচালক যেভাবে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন সেই চ্যালেঞ্জ নিতে বিন্দুমাত্র পিছপা হননি আশা।
উস্তাদ আলী আকবর খাঁ, সুলতান খাঁ, মাইকেল স্টিপ, ক্রানস কার্টেট এমন বহু শিল্পীর সঙ্গে দ্বৈত কাজ করেছেন।
বাবা দিননাথ মঙ্গেশকরের গান-নাটকের ট্রুপ ছিল। গানে হাতেখড়িটা সেখানেই। ১০ বছর বয়সে চলে গেলেন বাবা। অকূল পাথারে পড়ল পুরো পরিবার। সহায় সম্বলহীন। ছোটছোট ভাইবোন। সে ভাঙা তরীর হাল ধরলেন বড় দিদি লতা। সঙ্গী ছোট্টবোন। ১০ বছর বয়সে সঙ্গীত সফর শুরু হল। বাবার কাছে নাড়া বেঁধে ছিলেন। এবার তালিম গুরু দিদি। প্রথম গান ‘ চলা চলা নভবালা’। সন ১৯৪৩।
সফর চলছেই। কখনও ফুল, কখনও কাঁটায় ক্ষত বিক্ষত হয়েছে পথ চলা। রক্ত ঝরছে। বুক ফেটে গিয়েছে কান্নায়। ভিতর- ভিতর দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছেন। যত বেশি আঘাত এসেছে তত পাকা হয়েছে সুরের খেলার রঙ। কন্ঠের মোহিনী মায়া গভীর থেকে গভীরতর। আঁকড়ে ধরেছেন বুকের গোপন ঘরে আজন্মের স্বপ্নটাকে।
“ জ্যায়সে সঙ্গীত কভি নিচে কে সুর লাগাতে হ্যায়, অউর কভি উপর কে, জিন্দেগি ভি এয়সি হয় হ্যায়’
তাঁর কাছে জীবন আর সঙ্গীত মিলেমিশে একাকার। ছলছল স্রোতে এক অনন্ত বয়ে যাওয়া...