জিয়াগঞ্জের ছেলেটা

'ভাল গান'। ঠিক কেমন, বোঝার জন্য কোনও সংজ্ঞার প্রয়োজন হয় না। ভাল গান হল এমন, যা শুনতে শুনতে থমকে যেতে হয়। ভিতরে জমে থাকা বেদনার বুনোটগুলো আলগা হয়ে যায়। বুকের মধ্যে কান পাতলে মনে হয় বরফ গলে স্রোত হয়ে বয়ে যাচ্ছে। গান হবে তেমনই। শুধু তোমাকে নয়, তোমার কষ্টগুলোও ছোঁবে।

জিয়াগঞ্জের ছেলেটার গানই ঠিক তেমনি। ডুব যদি দাও, তবে আর পালাবার পথ নেই। মন শুধু মুহূর্তেই থমকে। গান গান গান...সুরের ঘোর কাটতেই চায় না। বুক মুচড়ে আসা অনুভূতির কথাগুলো ছেলেটা কেমন সুরে সুরে বলে দেয়। উথলে আসে কান্না, চলকে পড়ে অভিমান, তবু মুখের হাসিটি লেগেই আছে। কপালে বেখেয়ালি চুলের ঢেউ। গান যখন গায় তখন জলের দিকে দৃষ্টি। কোনদিকে যে তাকিয়ে আছে বোঝা যায় না। বোঝা যায় শুধু পালতোলা স্রোতে গানের বয়ে যাওয়া আর দর্শকদের আবেগ।

গানের জগতে বাঙালির দাদাগিরির ব্যাটনটা আজ সেই ছেলের হাতেই। মুর্শিদাবাদের জিয়াগঞ্জের অরিজিৎ। অরিজিৎ সিং।

arijit-young

শুরুর জার্নিটা সহজ ছিল না। জনপ্রিয় রিয়েলিটি শোয়ের প্রতিযোগী হিসেবে মুম্বইয়ে পা রেখেছিলেন। শুরু থেকে অরিজিতের গানে মুগ্ধ হয়েছিল তামাম দেশ। কিন্তু সেরা পাঁচে জায়গা করে নিতে পারেননি। তবে সেই প্রতিযোগিতার ব্যর্থতা তাঁকে দিয়েছিল জীবনের পাঠ। প্রতিযোগীতার চাপ, প্রতিদ্বন্দ্বিতার জটিলতা মানসিক ভাবে অস্থির করে তুলেছিল তাঁকে। প্রভাব পড়েছিল পারফর্ম্যান্সেও। একটা সময় কোনও প্রতিযোগী তাঁর জুটি বাঁধতে রাজী হত না। কিন্তু এক সময় ঘুরে গিয়েছিল খেলা। ব্যাটপ্যাচ কাটিয়ে রানে ফিরেছিলেন। বিচারকদের কাছে সেরা হয়ে উঠতেই বদলে যায় গোটা ছবি। অরিজিৎ শিখেছিলেন অন্যের ওপর নির্ভর করার চেয়ে ঢের ভাল নিজেই নিজের ভরসা হয়ে ওঠা। আর এক রিয়েলিটি শোয়ের প্রতিযোগী হয়েছিলেন অরিজিৎ। সেরার পুরস্কার হিসেবে পেয়েছিলেন ১০ লক্ষ টাকা। সেই অর্থ দিয়ে শুরু করেন নিজের স্টুডিয়ো। 

বলিউডের ইঁট কাঠ পাথরের দেওয়ালে ধাক্কা খেতে হয়েছে বারবার।  রাস্তা আটকেছে রাজনীতি,  কিন্তু এ ছেলে নাছোড়। কান্না মুছে, রক্ত সামলে, এগিয়ে চলেছেন নিজের লক্ষ্যে। অরিজিৎ শুধু জানতেন মুম্বইয়ের মন জিততে এসেছেন তিনি। পথ তাঁর একটাই। সে পথ থেকে সরানো যাবে না। পথ থেকে তাঁকে সরতে হয়নি। পথ নিজেই যে রাজপথ খুলে দিয়েছিল। এখন পথ সীমাহীন।  

Arijit-Base

বহুদিন পর্যন্ত তাঁর কোনও গাড়ি ছিল নিজস্ব। চলতে ভালোবাসতেন পাবলিক ট্রান্সপোর্টে। প্রথম দিকে গান রেকর্ড করতে যেতেন অটো সওয়ারে। কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদে নিজের বাড়ি ফিরতেন ট্রেনে। স্টেশন থেকে সাইকেল রিক্সায়।

যতই আকাশছোঁয়া সাফল্য আসুক তবু পায়ের পাতায় লেগে থাকা মাটির ছোঁয়াটুকু ভুলতে নারাজ অরিজিৎ। এই সময়ের অন্যতম সেরা প্লেব্যাক শিল্পী হয়েও জীবনযাত্রায় স্টারডমের স্পর্শ লাগতে দেননি। অবিন্যস্ত চুল, অযত্নের দাড়ি সব মিলিয়ে অরিজিৎ। তাঁর সহজ যাপনের ছবি কোথাও যেন বদলে দিয়েছে সেলিব্রিটি দুনিয়ার চেনা সংজ্ঞা।

ভালোবাসেন বাংলা সাহিত্য পড়তে। বিশেষ করে শিশু সাহিত্য। একটি এনজিও আছে তাঁর। ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ সমাজের অনগ্রসর ও দরিদ্র মানুষদের মধ্যে কাজ করে। রক্ত থেকে বই সব প্রয়োজনে সাড়া পাওয়া যায়।    

 

 

 

  

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...