মুসাফির হুঁ ইয়ারো
না ঘর হ্যায়, না ঠিকানা
হামে বস চলতে যানা হ্যায়
ব্যাস চলতে যানা না …
সাদা কুর্তা। সাদা পাজামা। সাদা চুল। সফেদ এক জন মানুষ। একমনে মাথা নিচু করে তাকিয়ে সাদা পাতার দিকে। হাতে কালো কলম। এক্ষুনি কালো অক্ষরে সেজে উঠবে পাতাটা। নাজম আর শায়রী শরীরের অপেক্ষায়...
নাম তার গুলজার। গুলজার সাহাব। তাঁর কবিতা মোমবাতির মতো গলিয়ে দেয় পাঠককে। খাঁ-খাঁ মনখারাপের মধ্যেও আলোর মতো জেগে থাকে ভালোবেসে রেখে যাওয়া পুরনো দিন।
যখন স্কুলে পড়তেন তখন থেকে পরিচয় ‘গুরুদেব’-এর লেখার সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথের অনুবাদ পড়তেন। শিরায় শিরায় বয়ে যেত শব্দ, কথারা। খেয়াল থাকত না সময়ের। গুরুদেব তাঁর আজীবনের শ্যাম সখা। চলার পথের রসদ। তাই বোম্বাই শহরের গ্যারেজে জীবন শুরু করেও নিয়তির পথে হয়ে গেলেন কবি। কবিতাপ্রেমী মানুষের বড় আদরের গুলজার সাহাব।
আসল নাম সম্পূরণ সিং কালরা। জন্ম ব্রিটিশ ভারতের ঝিলম জেলার দিনায়। এখন সেই অংশ পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত।
ছোটবেলা থেকেই বিচ্ছেদ বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে জীবনে। একদম ছোটবেলায় মাকে হারালেন। সেই সময় থেকেই যেন আরও বেশি করে ঘিরে ধরল কবিতা। সারাক্ষ্ণ একটা অস্থিরতা তাড়িয়ে বেড়াত। ছটফটানিটা যে ঠিক কোথায় বুঝতে পারতেন না।
ছেলের রকম-সকম খুব ভালো ভাবে নেননি বাবা মাখন সিং কালরা। তাই পাঠিয়ে দিলেন কাকার কাছে। আর তাতেই বদলে গেল জীবন।
ছেলের লেখার অভ্যাস মেনে নেননি সম্পূরণ সিং কালরার বাবা। তাঁর মনে হত ছেলে বাজে সময় নষ্ট করছে। বাবার চোখ এড়াতে পড়শির বাসায় কাগজ-কলম নিয়ে বসতেন। গুলজার দেনভি নামের আড়ালে নিয়মিত লিখতে শুরু করলেন।
তবে গুলজার দেনভির জীবনের সবচেয়ে বড় বদল এল ১৯৪৭-এ। দেশভাগের ধাক্কা। বাপ-ঠাকুরদার ভিটে, চেনা মাটি সব ছেড়ে রাতারাতি ঘরছাড়া। গায়ে লেগে গেল উদ্বাস্তুর ছাপ। রক্ত-কান্না-হাহাকার আর যন্ত্রণার ক্ষত পাকাপাকি দাগ ফেলে দিল মনে। সেই ঘা কখনও সারেনি। ৮৪ বছর বয়সে সেই যন্ত্রণার টানেই লিখেছিলেন জীবনের প্রথম উপন্যাস ‘টু’। ইংরেজি ভাষায় লেখা উপন্যাসের প্রতি শব্দে তিনি ধারণ করেছিলেন ১৫ লক্ষ ঘরহারা মানুষের কান্নার স্রোতকে।
দেশভাগের পর ভারতে এসে অনেকটা সময় কেটেছিল অমৃতসর আর দিল্লিতে। তারপর চলে আসেন বোম্বাই। মাথার ওপর ছাদ নেই, অন্নের সংস্থান নেই জীবন কোনদিকে বাঁক নেবে তার আন্দাজ তো তখন দুঃসাধ্য ভাবনা। দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের যোগানের জন্য মেকানিকের কাজ নিলেন এক গ্যারেজে। দিনের বেলা গ্যারেজে কাজ। তেলকালির দাগে ভরে যায় হাত। কিন্তু মন ভরে ওঠে কলমের টানে। মাথার মধ্যে ঢেউ ওঠে কবিতার। রাতে কাগজে কলমে ধরে রাখেন বদলে যাওয়া জীবন আর সময়কে। অশান্ত দিন আশ্রয় খোঁজে শের-শায়েরি-নাজমের বুকে মুখ গুঁজে। ডানায় রক্তের দাগ ধুয়ে যায় চাঁদের জ্যোৎস্নায়।
প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স ফাউন্ডেশনের লেখকদের সঙ্গে যোগাযোগ হল। বন্ধুত্ব হল কয়েকজনের সঙ্গে। প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স ফাউন্ডেশন তখন গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন। কৃষ্ণ চন্দর, রাজিন্দর সিং বেদি, শৈলেন্দ্রর মতো মানুষরা যুক্ত তার সঙ্গে। শৈলেন্দ্র সেই সময় গীতিকার হিসেবে যথেষ্ট সাড়া ফেলেছেন।
শৈলেন্দ্রর সঙ্গে খুব ভাল বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। সেই বন্ধুত্ব থেকেই জন্ম নিল গুলজারের প্রথম গান। সেও এক গল্প। তিনি চাইলেন বন্ধু গুলজার গান লিখুক বিমল রায়ের ছবি ‘বন্দিনী’র জন্য। অবাক করার মতো ব্যাপার হল এমন প্রস্তাবে কিন্তু কিছুতেই রাজী হতে চাইলেন না গুলজার। কিন্তু শৈলেন্দ্র নাছোড়। শেষ পর্যন্ত জিত হল তাঁরই। গুলজার ফেরাতে পারলেন না বন্ধুকে। লিখলেন ‘মোরা গোরা রঙ লাই লে’। নতুন লিখিয়ের গানের কথা শুনে মুগ্ধ হলেন বিমল রায়। বলিউড অভিষেক ঘটল ২৯ বছরে পা দেওয়া যুবক গুলজারের।
বিমল রায় তাঁর সহকারী হয়ে যেতে বললেন। যেন নবজন্ম হল সম্পূরণ সিং কালরার। পরবর্তী সময়ে ছবি তৈরীর মাস্টারমশাই হিসেবে পেলেন আরও এক বিখ্যাত মানুষকে। হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়। তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়া গুলজারের জীবনের বড় টার্নিং পয়েন্ট।
নিজেকে মুসাফির ভাবতে ভালোবাসেন। আলো আর অন্ধকার ছুঁয়ে কেবলই হেঁটে চলা। গন্তব্য যেখানেই হোক সফরের পথ আনন্দের। বাস্তবকে বাদ দিয়ে কখনও অলীক কাব্য রচনা করেননি তিনি। পথ চলার কাব্য ঠিক সেভাবেই উঠে এসেছে তাঁর কলমে যেভাবে তিনি পথ পেরিয়েছেন।
‘গুড্ডি’ ছবির জন্য লিখেছিলেন, ‘হামকো মন কি শক্তি দেনা/মন বিজয় করে’ আজও দেশের অনেক স্কুলে প্রার্থনার গান হিসেবে প্রতিদিন গায় ছাত্রছাত্রীরা। ছোট্ট ছোট্ট খুদেদের মন আলো আর বিশ্বাসে ভরে উঠুক এই তাঁর কামনা। আগামীর কঠিন পথে চলতে গিয়ে তারা যেন জোর না হারায়। বারবার তাঁর কলম এ কথাই বলে এসেছে বারবার…স্রোতে মিশিয়ে স্রোতের বিপরীতে চলা সহজ নয়। তাই তিনি লেখেন,
কুছ আলগ করনা হ্যায় তো
ভিড় সে হটকে চলিয়ে
ভিড় সাহস তো দেতি হ্যায়
মগর পহেচান ছিন লেতি হ্যায়…
কিছু অন্যরকম করতে চাইলে ভিড় এড়িয়ে চলো। ভিড় সাহস দেয়, কিন্তু পরিচয় কেড়ে নেয়। মুখের ভিড়ে মিশে থাকলে তুমি শুধুই মুখ…