উনিশ শতক ( ১৮৫৮-১৯৪৭ ), ইংরেজরা রমরমিয়ে ভারত শ্বাসন করেছে ।যদিও নারী প্রগতিতে ইংরেজদের অসামান্য অবদান ভোলার নয়, তবুও সমাজ তখন পুরুষতান্ত্রিক । ১৮৯৩,এমন সময় চুনীবাবু ওরফে হৈমবতী সেন - হুগলির লেডি ডাফরিন হাসপাতালের মহিলা চিকিৎসক।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শেকল ভেঙে পাঁচ বছরের কষ্টের ফসল হিসেবে পাঁচটি মেডেল ও সার্টিফিকেট পেলেন- "‘ভার্নাকুলার লাইসেনশিয়েট ইন মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি" সেই সময় দাঁড়িয়ে এটি এমন একটি মেডিকেল ডিগ্রী যার ঐতিহাসিক মূল্য বর্তমানের MBBS ডাক্তারদেরও হার মানাবে।
মা ভেবেছিলেন ছেলে হবে |ছেলে পাওয়ার আশায় অন্যান্য রক্ষণশীল হিন্দু পরিবারের মতো তিনিও পুজো আর্চার খামতি রাখেননি কিন্তু মেয়ে যে ছেলের চাইতেও বড়ো কাজ করবে তা কল্পনাও করতে পারেননি গরবিনী মা। বাংলাদেশের - খুলনায় জন্ম হয় হৈমবতীর( ১৮৬৬ )|মা ,ঠাকুমা ছোট্ট মেয়েকে ভালোবাসা না দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলেও বাবা প্রসন্নকুমার ঘোষ হৈমকে বুকে করে আগলে রাখলেন।চাইলেন তার মেয়ে যেন ছেলের চেয়ে কোনো অংশে কম না হয় |
কিন্তু সোনার বাংলায় জন্মানো মেয়ে সোনা ফোলাবেই,দাদা-ভাইদের পড়াশোনা করতে দেখে তারও ইচ্ছা করত পড়াশোনা করতে,শিক্ষকদের থেকে বাবার সাহায্যে শুনে-শুনেই পড়াশোনা অনেকটা রপ্ত করেছিলেন হৈম। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নির্মমতায় মাত্র ৯ বছর বয়সে বিয়ে দিতে বাধ্য হয় অসহায় পিতা |
বছর পঁয়তাল্লিশের বিপত্নীক পাত্রের যৌন ক্ষুধা মেটাতে না পারায় স্বামী গণিকা নিয়ে আসতেন। কিছু বছরেই ছোট্ট হৈম বিধবা হলেন , শ্বশুরবাড়ি , বাপের বাড়ির সব দরজা যখন বন্ধ ; নিঃসম্বল ও নিরুপায় হয়ে যুবতী হৈম কাশীবাসী হলেন।
মানুষের একটাই জীবন আর একবারই মরণ |ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবনযাপন কোনো জীবনই নয়- এ কথা বোঝার পর সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় কলকাতা চলে এলেন ,খরচ চালাতে স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি নিলেন। কিন্তু মন কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না , তাঁকে আরও বড়ো কিছু করতে হবে।
ব্রাহ্মসমাজের মাধ্যমে জানতে পারলেন ক্যাম্পবেল মেডিকেল স্কুলে ছাত্রী নেওয়া হবে | শুরু হল তাঁর জীবনের এক অন্য অধ্যায়। ডাক্তারি পড়ার শুধু সুযোগই পেলেন না ,সঙ্গে বৃত্তিও পেলেন ।
তিন বছর পরে হুগলির লেডি ডাফরিন হাসপাতালে মহিলা চিকিৎসক হিসেবে কাজে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। ষোলো বছর ধরে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আর নিখুঁত পরিচর্যার মাধ্যমে রুগীদের সেবা করে গেলেন চুনিবাবু ওরফে হৈমবতী । যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি না থাকায় এলএমএস ডিপ্লোমা তাঁকে দেওয়া হয়নি। কয়েকজন সহকর্মীর ভাষায় চুনিবাবু হলেন শিক্ষণপ্রাপ্ত দাই। দ্বিতীয় বিবাহের পরও শান্তি পেলেননা সেইভাবে, স্বামীর মৃত্যুর পর সংসারের সব দায়িত্ব ও হাসপাতালের দায়িত্ব সমানভাবে কাঁধে তুলে নিষ্ঠা ভরে কাজ করে গেলেন।
শুধু ডাক্তারিতেই চুনিবাবু নিজেকে বেঁধে রাখেননি ,রচনা করলেন কবিতা ও গল্প । তাঁর আত্মজীবনী ‘স্মৃতিকথা’ ২০০০ সালে ইংরেজিতে অনুবাদ হয়, ‘মেমোরিজ় অফ ডক্টর হৈমবতী সেন— ফ্রম চাইল্ড উইডো টু লেডি ডক্টর’ নামে।
১৯৩৩ সালে ৬৭ বছর বয়সে মারা যান হৈমবতী কিন্তু আজও তিনি বাঙালি নারীদের গর্বের কারণ হয়ে রয়েছেন।