বিদেশি বাদ্য। কিন্তু তাতেও বাঙালির অহংকার লেগে আছে। সে-হল ‘ডোয়ার্কিন্স’ হারমোনিয়াম। বাঙালির সাংগীতিক ঐতিহ্যের ইতিহাসে অনুষঙ্গ এই হারমোনিয়ামের সৃজন ও সমৃদ্ধি ঘটেছিল দ্বারকানাথ ঘোষের হাতে। তাই তাঁর নামেই এই হারমোনিয়ামের নাম হয়। এই দ্বারকানাথই ছিলেন আমাদের বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের পিতামহ। বলতে কী, হারমোনিয়ামে জ্ঞানপ্রকাশের দক্ষতা ছিল অবিসংবাদিত। আসলে, অমন কৃতী পিতামহের ঘরে যাঁর জন্ম, সেই জ্ঞানপ্রকাশ হারমোনিয়াম বাদনে যে দক্ষতার চূড়ান্ত হয়ে উঠবেন, তাতে আর বিচিত্র কী! হারমোনিয়াম বাদনে তাঁর ওপর ওস্তাদ আমীর খাঁ-সাহেবের আস্থা এতটাই ছিল যে, আপন গানের আসরে তিনি শুধু জ্ঞানপ্রকাশকেই হারমোনিয়ামে সঙ্গত করতে দিতেন, আর কাউকে না। এই আস্থা অতীব গৌরবের, কিন্তু অর্জন করা সহজ না।
জ্ঞানপ্রকাশ শুধু যে অপূর্ব হারমোনিয়াম বাজাতেন, তাই নয় তবলা, পাখোয়াজ, ক্ল্যারিনেট, পিয়ানো, অর্গ্যান, কর্ণেট প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রেও তাঁর অসম্ভব দক্ষতা ছিল। আসলে, বাড়িতে এমন একটা সাঙ্গীতিক সব পেয়েছির পরিবেশ ছিল যে, সঙ্গগুণে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের প্রতি ভালোবাসা এসে গিয়েছিল, তা থেকে সবটাই যেন আয়ত্ত হয়ে গিয়েছিল। সকলের মাঝে এভাবেই তাঁর সঙ্গীতের একান্ত সাধনার স্রোত পরিবারের প্রবাহের মধ্যে মিশে বয়ে চলেছিল পরম নিশ্চিন্তে। সমৃদ্ধ হয়ে চলেছিল।
সঙ্গীতকে সাধনার বস্তু যারা করেছেন, তাঁরা বিদ্যার দিকে ততটা মনোযোগ দিতে পারেননি—এমন উদাহরণ আকছার দেখা যায়। কিন্তু জ্ঞানপ্রকাশ সেই উদাহরণে ব্যতিক্রম। তিনি প্রেসিডেন্সির কৃতী ছাত্র। স্নাতকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়া ছাত্র। খেলাধূলায় ওস্তাদ। খেলতে গিয়ে দুর্ঘটনাও ঘটে। ফুটবল খেলতে গিয়ে একটি চোখ সারাজীবনের জন্য নষ্ট হয়ে যায় তাঁর।
সঙ্গীতজীবনে জ্ঞানপ্রকাশ অনেক গুণীর সঙ্গ করেছেন। অনেক ওস্তাদের সঙ্গে তবলা বাজিয়ে হারমোনিয়াম বাজিয়ে বিখ্যাত হয়েছেন। ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্তের’ মতো ক্লাসিক ছায়াছবিতে ধরা আছে তাঁর সুরের মূর্ছনা। রেকর্ডে ধরা আছে তাঁর সৃষ্টি করা সঙ্গীত। আজও সুযোগ্য শিষ্যেরা বয়ে চলেছেন তাঁর পথের ধারা। তাঁর এই ধারা, সমস্ত সৃষ্টি আমাদের কাছে পরম শ্রদ্ধার বস্তু; সমাহিত হয়ে উপলব্ধি করার জিনিস। এই শ্রদ্ধা বাঙালি সঙ্গীতকার-শিল্পীদের অনেককেই জানানো যায়। কিন্তু জ্ঞানপ্রকাশের শিল্পীসত্তা ও সৎ-ব্যক্তিত্ব মিলেমিশে এমন এক বিভা তৈরি করে যে, তা আমাদের নত হতে বাধ্য করে। তাই তাঁর প্রতি আমাদের অন্তহীন শ্রদ্ধা শুধুই সঙ্গীতের জন্যই নয়; তাঁর বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব, তাঁর সততা, তাঁর সাহসী ও প্রতিবাদী সত্তাটির জন্যও বটে। সৎ-ভাবে প্রতিবাদী হয়ে ওঠার অবকাশ তাঁর জীবনে বেশ কয়েকবার ঘটেছে। তারই একটি বলিঃ
সঙ্গীতের আসরে অনেক বড় বড় গাইয়ে বা বাজিয়ের প্রবণতা থাকে সঙ্গতকারী বাজিয়েকে ছোট করে নিজেকে বড় প্রমাণ করার। একবার ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ-সাহেবও সেই ফিকিরে পড়লেন। তাঁর সঙ্গে তবলা বাজাচ্ছিলেন জ্ঞানপ্রকাশ। খাঁ-সাহেব ওস্তাদলোক। অপূর্ব অসাধারণ তালে-লয়ে সরোদ বাজাতে বাজাতে এক সময় শুরু করলেন বেতালা বাজাতে। শ্রোতাদের কাছে প্রমাণ করতে চাইলেন জ্ঞানপ্রকাশের তবলাই যেন তালে থাকছে না। এই শঠতা জ্ঞানপ্রকাশ বুঝলেন। শিল্পের নামে এই শঠতা তিনি মেনে নিতে পারলেন না। আর তাছাড়া এ তো তাঁর সুনামকেও ক্ষুন্ন করছে! সুতরাং তিনি প্রতিবাদ করলেন। খাঁ-সাহেব এই প্রথম না, এর আগেও এভাবে অন্য সঙ্গতকারের সঙ্গে আসরে কিস্তিমাত করেছেন। সেই সব সঙ্গতকারেরা তাঁর মুখের ওপর কিছু বলার সাহস পাননি। তাই জ্ঞানপ্রকাশ প্রতিবাদ করতেই খাঁ-সাহেব রাগ করলেন। যথারীতি দোষ চাপালেন জ্ঞানপ্রকাশেরই ওপর। শ্রোতাভর্তি আসরে সকলকে শুনিয়ে মুখের ওপর বললেন, ‘আপনার সঙ্গে আমি কি বাজাইব। তবলায় আপনার ডাঁয়া বাঁয়া কোনটাই তো ঠিক হয় না অথচ আপনি তো কলকাতার ওস্তাদ হইয়া বইসা আছেন!’
বললে অনেক কথাই বলা যেত। কিন্তু সঙ্গীতের এই আসরটাকে জ্ঞানপ্রকাশ বাদ-প্রতিবাদের আখড়া করে তুললেন না। ঝগড়ার কলতলা করে তুলতে চাইলেন না। আবার জোড় হাতে অপমান গিলে নতি স্বীকার করে আত্মমর্যাদা নষ্ট করবার মানুষও তিনি ছিলেন না। তাই মাথা উঁচু করে আসর থেকে তক্ষুনি উঠে চলে গেলেন। বিষয়টা সেখানেই শেষ হয়ে গেল না। ভরা আসরে তাঁর এবং তাঁর সঙ্গীতের সেই চরম অপমানের বিরুদ্ধে জ্ঞানপ্রকাশ আইন দিয়েই লড়তে মনস্থ করলেন। এবং অবিলম্বেই খাঁ-সাহেবকে উকিলের চিঠি ধরালেন। চিঠি পেয়ে খাঁ-সাহেব প্রমাদ গণলেন। সাত-তাড়াতাড়ি শিষ্য-পুত্র পণ্ডিত রবিশঙ্কর এবং আলী আকবর খাঁ-সাহেবকে পাঠালেন মধ্যস্থতা করতে। তাঁদের মধ্যস্থতায় ব্যপারটা অবশ্য মিটে গেল। কিন্তু আসরের ইতিহাসে রয়ে গেল জ্ঞানপ্রকাশের অমোঘ প্রতিবাদ, উদাহরণ হয়ে…
ঋণঃ ‘তহজীব-এ-মৌসিকী’ - জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ।