মহাভারতের গল্পে আয়োদ ধৌম্য নামে এক সুবিখ্যাত ঋষি ছিলেন। তাঁর অনেক শিষ্যের মাঝে উপমন্যু নামে এক শিষ্য ছিলেন। যে সময়ের কথা বলছি, তখন সবে উপমন্যু গুরুর আশ্রমে এসেছেন বেদপাঠের শিক্ষা নিতে। কিন্তু, সে যুগে শিক্ষা খুব একটা সহজ ছিল না। শিক্ষা তখন সমস্তটাই শ্রুতি। শুনে শুনে মনে রাখতে হত। শিক্ষার ওপর প্রবল অনুরাগ ও জেদ না-থাকলে এভাবে শিক্ষিত হওয়া যায় না। তাই অপাত্রে শিক্ষা দান করা হত না, অযোগ্যকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হত না। শিষ্যকে নিয়মনিষ্ঠাসংযমে গুরুর আশ্রমে বাস করতে হত। তাকে নানান অবস্থার মধ্যে ফেলে যাচাই করে নেওয়া হত। গুরুর গৃহকর্ম ও পদসেবা করতে হত। উপমন্যুর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। আয়োদ ধৌম্য তাঁকে আশ্রমের গাভিগুলি চারণের ভার দিলেন।
উপমন্যু প্রতিদিন গরু চরাতে যান আর সন্ধ্যাবেলায় ফিরে গুরুর চরণ বন্দনা করেন। এবং তারপরই সারাদিনে একবার মাত্র আহার গ্রহণ করেন। তাতে শরীর কৃশ হওয়ার কথা। কিন্তু, আয়োদ ধৌম্য খেয়াল করলেন, উপমন্যুর শরীর যেন দিনকে দিন আরও হৃষ্টপুষ্ট হয়ে উঠছে। তাই একদিন তিনি শিষ্যকে বললেন, বাপু হে, গোচারণে গিয়ে দিনমানে তুমি কি কিছু খাও? উপমন্যু হাতজোড় করে সত্য কথাই বললেন, গুরুদেব, আমি দিনমানে ভিক্ষা করি, তাতে যা পাই তাই খাই। আয়োদ ধৌম্য বললেন, এ তো বাপু ঠিক না, তুমি ভিক্ষে করে আহার করো, অথচ গুরুকে নিবেদন করোনা, এ তো ভালো শিক্ষা না! তাই শুনে উপমন্যু লজ্জিত হলেন। তিনি এরপর থেকে ভিক্ষে করে তা গুরুকে নিবেদন করতে শুরু করলেন।এবং, আয়োদ ধৌম্যও সেই ভিক্ষায় পাওয়া আহার্য সামগ্রীর প্রায় সবটাই গ্রহণ করতে লাগলেন। যেটুকু থাকত তাতে আর উপমন্যুর পেট যেন ভরতেই চায় না! এমনি করে কিছুদিন গেল। তবু গুরুদেব অবাক হয়ে দেখলেন শিষ্যের শরীর যে কে সেই, অর্ধাহারের ছাপ তো নেই! আবার জিজ্ঞেস করলেন, বাপু ব্যাপারখানা কি বল তো? উপমন্যু বললেন, প্রভু, আপনাকে নিবেদন করার পর আমি আবার ভিক্ষা করি, তা থেকে যা পাই তাই দিয়ে উদর পূরণ করি। তাই শুনে আয়োদ ধৌম্য বললেন, এ তোমার ভারি অন্যায়, এতে তো অন্য ভিক্ষুকদের অন্নসংস্থানের ক্ষতি হচ্ছে, তুমি তাদের বঞ্চিত করছ! এতে ভারি লজ্জা পেয়ে উপমন্যু গুরুর পদবন্দনা করে বললেন, ক্ষমা করুন প্রভু, এমন অন্যায় আর হবে না।
আরও কিছুদিন গেল। তবু দেখা গেল, দিনকে দিন আরও হৃষ্টপুষ্ট হচ্ছেন উপমন্যু। গুরুদেব আবার জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপারখানা কি? উপমন্যু জানালেন, দিনের বেলায় তাঁর খুব ক্ষিদে পায়, কিছুতেই চাপতে পারেন না। ভিক্ষেও বন্ধ। তাই এখন তিনি গভীদের দুধ পান করেন। এতে গুরুদেব খুব রেগে হলেন, বলো কী! আশ্রমের গাভীর দুধ পান করছ, বাছুরদের বঞ্চিত করছ, এ তো আরও অন্যায় করছ উপমন্যু! এরপর, উপমন্যুর দুধ খাওয়া বন্ধ হল। কিন্তু, কিছুতেই খিদের জ্বালা সহ্য করতে পারলেন না। বাছুরদের দুধ খাওয়ার পর কষ বেয়ে যে ফেনা গড়িয়ে পড়ে, তা-ই আহার করতে শুরু করলেন। তাতেও গুরুর ভর্ৎসনা শুনতে হল। গুরু বললেন, এতে নাকি বাছুরেরা উপমন্যুকে দয়া করে নিজেদের অভুক্ত রাখছে, দুধ কম খেয়ে কষ বেয়ে গড়িয়ে দিচ্ছে! ফলে, বাছুরদের মুখের ফেনা খাওয়াও বন্ধ হল।
খুব আতান্তরে পড়লেন উপমন্যু। দিনের বেলা গোচারণে গিয়ে যথারীতি খিদের জ্বালায় অস্থির হলেন। কিন্তু, গুরুর নিষেধে ভিক্ষে করতে পারলেন না, দুধ বা দুধের ফেনা কিছুই খেতে পেলেন না। মাঠের মাঝে খাবারই বা কোথায়! খিদের জ্বালা সইতে না পেরে সামনে একটা আকন্দের গাছ দেখতে পেয়ে হতবুদ্ধি হয়ে তার পাতা খেতে লাগলেন। তাতেই হল বিপত্তি। চোখ অন্ধ হয়ে গেল। সেই অবস্থায় হাতড়ে হাতড়ে আশ্রমে ফিরতে গিয়ে তিনি পড়ে গেলেন একটা শুকনো কুয়োয়।
দিন ফুরিয়ে সন্ধ্যে হল। গাভীগুলো একা একা বাড়ি ফিরে গেল। তবু, উপমন্যু ঘরে ফিরলেন না। তখন খুব চিন্তা হল আয়োদ ধৌম্যর। তিনি খুঁজতে বেরুলেন শিষ্যকে। মাঠে গিয়ে তিনি উপমন্যুর নাম ধরে ডাকতে লাগলেন। কুয়োর ভেতর থেকে সাড়া দিয়ে উপমন্যু গুরুকে জানালেন নিজের দুরবস্থার কথা। গুরু বললেন স্বর্গের চিকিৎসক অশ্বিনীকুমারদের স্তব করতে। উপমন্যুর স্তবে তুষ্ট হয়ে অশ্বিনীকুমাররা আবির্ভুত হলেন এবং উপমন্যুর দৃষ্টি ফিরিয়ে দিলেন। আশীর্বাদ করলেন সর্বশাস্ত্রজ্ঞ ও বেদজ্ঞ হয়ে ওঠার। এদিকে আয়োদ ধৌম্যও শিষ্যের এই কৃচ্ছসাধনায় ভারি তুষ্ট হলেন। তিনি পঞ্চপিতার এক পিতা, গুরুদেব। সন্তানসম শিষ্যকে শিক্ষাদানের পূর্বে তাঁর আধার বুঝে নিচ্ছিলেন। আধার অনুযায়ী এবার দেওয়া হবে শিক্ষা। উপমন্যুর মতো শিষ্য পেয়ে তিনি আজ গর্বিত। শিষ্যকে কুয়ো থেকে তুলে জড়িয়ে ধরলেন বুকে। উপমন্যুর শ্রমপর্ব শেষ হল, শুরু হল আশ্রমের শিক্ষা পর্ব।