কথা রাখতে শিশুকন্যার সৎকার করে কাজে যোগ দিয়েছিলেন গুরুদাস ব্যানার্জি

উল্টডাঙা স্টেশন হয়ে কর্ড লাইনে পার্ক সার্কাস স্টেশনে যেতে মধ্যিখানে নারকেলডাঙায় একটি স্টেশন পড়ে, যার নাম ‘স্যার গুরুদাস ব্যানার্জি হল্ট’। এ-কথা আমরা যারা শেয়ালদা লাইনে নিত্য যাতায়াত করি, সবাই জানি। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না যে, কে এই গুরুদাস ব্যানার্জি, কেনই বা তাঁর নামে এখানে স্টেশনটির নামকরণ করা হল?

গুরুদাস ব্যানার্জি উনিশ শতকের এক বিখ্যাত মনীষা। বাংলার আইন জগতে ইংরেজের প্রতিস্পর্ধী এক ব্যক্তিত্ব, স্বনামধন্য উকিল, কলকাতা হাইকোর্টের বিখ্যাত জজ, প্রথিতযশা অধ্যাপক, বাংলার শিক্ষা-সংস্কারক। তাঁর জন্ম হয়েছিল ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি কলকাতার নারকেলডাঙায়। কৃতবিদ্য গুণী এই মানুষটিকে সম্মান জানাতে তাঁর জন্মস্থানে তৈরি হওয়া হল্ট স্টেশনটি ১৯৯৫ সালে তাঁর নামে নামাঙ্কিত করা হয়।

আমরা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মশাইয়ের মাতৃভক্তি ও সত্যনিষ্ঠার কথা সকলেই জানি, উদাহরণ দিই। গুরুদাসের সত্যনিষ্ঠা ও মাতৃভক্তিরও কোন তুলনা ছিল না। বলতে কি, মা সোনামণি দেবীর কাছেই তিনি মানুষ। জন্মের তিন বছরের মধ্যেই তিনি পিতাকে হারান। সজ্ঞানে পিতার সান্নিধ্য তিনি পাননি। তবে মা ছিলেন অত্যন্ত দৃঢ়চেতা মহিলা। একলা হাতে পুত্রের চরিত্র গঠন থেকে শুরু করে ভালো স্কুলে শিক্ষাদান প্রভৃতি সমস্ত দিকে খেয়াল রেখে মেরুদণ্ড সোজা রেখে মানুষ হতে শিখিয়েছিলেন।

সোনামণি খুব বেশি পড়াশুনো জানতেন না, আর-পাঁচজন সেকেলে মায়ের মতোই ধর্মকাতর, সামাজিক রীতিনীতির অনুগত ছিলেন; তবুও তাঁর মধ্যে প্রবল আত্মসম্মানবোধ তো ছিলই, সেই সঙ্গে তাঁর মধ্যে অসাধারণ এক দূরদৃষ্টি ও মুক্তদৃষ্টির সমন্বয় ঘটেছিল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, উনিশ শতকের যে লগ্নে পুত্র জন্মগ্রহণ করেছেন, তাতে পাশ্চাত্যশিক্ষা না-হলে চলবে না। তাই বাংলা, সংস্কৃতের পাশাপাশি ইংরেজি ভাষাও ছেলেকে যত্ন করে শেখানোর ব্যবস্থা করেন। ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, হেয়ার স্কুল, প্রেসিডেন্সি কলেজের মতো সব বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানে ছেলেকে ভর্তি করেন। এই সব প্রতিষ্ঠানে গুরুদাস রিচার্ডসন সাহেব, প্যারীচরণ সরকার, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যের মতো পণ্ডিতদের শিক্ষক হিসেবে পেয়েছেন। তাঁদের শিক্ষায় প্রতিটি পরীক্ষায় প্রতিটি ক্লাসে প্রথম হয়ে গুরু ও মায়ের মুখ উজ্জ্বল করেন।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ পাশ করে প্রেসিডেন্সি কলেজে গণিতের অধ্যাপনা দিয়ে গুরুদাসের কর্মজীবন শুরু হয়। শিক্ষক হিসেবে যথেষ্ট সুনাম অর্জনের পাশাপাশি চলতে থাকে আইন নিয়ে পড়াশুনোও। পড়িয়ে এই সময় তাঁর মাসে একশো টাকার মতো রোজগার হচ্ছিল। এই টাকায় সংসার চালাতে অসুবিধে ছিল না। মা-ও ছিলেন বেশ খুশি।

কিন্তু আইন পাশ করার পরই বহরমপুর কলেজের অধ্যক্ষ সটক্লিফ সাহেব তাঁকে বিশেষভাবে অনুরোধ করেন তিনশো টাকার বিনিময়ে অঙ্ক ও আইন পড়ানোর জন্য। মায়ের ইচ্ছে ছিল না যে, গুরুদাস কলকাতার বাইরে যান। কিন্তু সাহেবের অনুরোধ কিছুতেই গুরুদাস ফেলতে পারলেন না। গুরুদাসের পক্ষে সে হয়ে উঠল এক উভয় সঙ্কট। মামাকে দিয়ে মাকে রাজি করানোর চেষ্টা করলেন। মা বারে বারে বললেন যে, তাঁর মন বলছে ওখানে না-যাওয়াই ভালো! তবু ছেলের সঙ্কট বুঝে মা নিমরাজি হলেন। গুরুদাস মাকে সঙ্গে নিয়ে সপরিবারে বহরমপুর গেলেন বটে, কিন্তু সইল না; সেই রাতেই মায়ের আশঙ্কা সত্যি করে কলেরায় তাঁর ‘মোহিনী’ নামের শিশুকন্যাটির মৃত্যু হল।

শোক এল। কিন্তু কাজ ছেড়ে নিজেকে গুটিয়ে নিলেন না গুরুদাস। পরদিন কাজে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে কথার খেলাপ করলেন না তিনি। মেয়ের সৎকার করে কাজে যোগ দিলেন। কথার দাম রাখার যে শিক্ষা মা তাঁকে দিয়েছিলেন, সারা জীবন তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন গুরুদাস।

বহরমপুরে শিক্ষকতা করতে করতেই এল পেশা পরিবর্তনের ডাক। মুর্শিদাবাদের বিখ্যাত দেওয়ান বংশের জামাই সম্পত্তি দখলের জন্য মামলা করল। চাইল বিধবা শাশুড়িকে বঞ্চিত করতে। টাকা ছড়িয়ে বড় বড় উকিল লাগাল। সে এক দারুণ হই হই কাণ্ড শুরু হল মুর্শিদাবাদ জুড়ে। সরকারিপক্ষের উকিলের ইংরেজি বলার ক্ষমতা নেই। ফলে, শাশুড়ির অবস্থা সঙ্গীন হয়ে উঠল। এই অবস্থায় মায়ের আদেশে গুরুদাস সেই বিধবার পাশে দাঁড়ালেন। শুধু দাঁড়ালেনই না, বাঘা বাঘা উকিলদের যুক্তিপ্রমাণে জেরবার করে জামাইকে সাত দিন জেল খাটিয়ে বিধবার অধিকার ফিরিয়ে দিলেন। এতে ডাকসাইটে উকিল হিসেবে গুরুদাসের নাম ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। মুর্শিদাবাদের নবাব তাঁকে একেবারে আইনি উপদেষ্টা করে নিলেন। ঠিক এই সময় মায়ের কথায় গুরুদাস আবার সপরিবারে কলকাতায় ফিরে হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করে দিলেন।

কলকাতায় তিনি মামলার দৈনিক ফি ঠিক করলেন পঞ্চাশ টাকা। সত্যমিথ্যা জড়ানো এই পেশায় এসেও গুরুদাস মায়ের সত্যনিষ্ঠার শিক্ষা ত্যাগ করেননি। একটি মামলা চলতে চলতে বহরমপুর থেকে আর-একটি মামলার ডাক আসে। আসে দৈনিক দেড় হাজার টাকা দেওয়ার প্রলোভন। উনিশ শতকের শেষ দিকে দেড় হাজার টাকা ‘অনেক’। কিন্তু সত্যের জন্য সেই ‘অনেক’ টাকার প্রলোভন উপেক্ষা করতে গুরুদাস দ্বিধা করেননি।

আইনে ডি এল ডিগ্রি অর্জন করে গুরুদাস ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন। টানা ষোল বছর এই পদ অলঙ্কৃত করে স্বেচ্ছায় অবসর নেন। যতদিন তিনি এই পদে ছিলেন, একদিনের জন্যও আদালতে তাঁর অনুপস্থিতি দেখা যায়নি। বাড়িতে অসুস্থ পুত্র যতীন্দ্রনাথ মৃত্যুর ক্ষণ গুণছে; এমন পরিস্থিতিতেও তিনি কর্তব্য বিচ্যুত হননি। অবিচলিতভাবে নিজের কর্তব্য করেছেন। যেদিন ছেলেটি মারা গেল, মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগেই তিনি কাজ সেরে ফেরেন। সেদিন পিতাপুত্রে শেষ দেখা হয়েছিল, এটুকুই সান্ত্বনা। তখন পালন করেন পিতার কর্তব্য। ব্যক্তি ও কর্মজীবনে এমন কর্তব্যনিষ্ঠ ও সত্যনিষ্ঠ পুরুষ বনফুলের ‘অগ্নীশ্বর’ উপন্যাস ছাড়া বাস্তবে চট করে চোখে পড়ে না।

পরাধীন ভারতে কর্তব্যময় এই মানুষটি বিবাহের পর মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার নিয়ে যেমন সরব হয়েছিলেন, তেমনি স্ত্রীশিক্ষার ব্যাপারেও ছিলেন সমান উৎসাহী। বাংলার শিক্ষাজগতে তাঁর দান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণযোগ্য। বিদ্যালয়ের শিক্ষায় সরকারি হস্তক্ষেপের তিনি ছিলেন বিরোধী, শিশুশিক্ষায় মারধরের বাইরে আনন্দ-খেলার মধ্য দিয়ে শিক্ষাদানের তিনি পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষায় শিক্ষাদানের প্রধান উদ্যোক্তাও ছিলেন তিনি। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভারতীয় উপাচার্য, ইংরেজ সরকার তাঁকে সাম্মানিক ‘স্যার’ উপাধি দেয়। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের ২ ডিসেম্বর বিবিধ জাতীয়তাবাদীকর্মের কাণ্ডারি এই মানুষটির জীনবনাবসান হয়।                 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...