গুরুর খোঁজে ঘর ছেড়ে ভীমসেন জোশী যখন একা পথে নামলেন, তখন তাঁর মাত্র এগারো বছর বয়স। তাঁকে গুরুর জন্য আকুল করে তুলল, পথে টেনে আনল একটা রেকর্ড, দুটো গান, দুটো রাগ আর এক ওস্তাদের গায়কী। ওস্তাদের নাম, আব্দুল করিম খাঁ সাহেব। ঝিঁঝিট রাগে গাওয়া ‘পিয়া বিন নেহি আবত চ্যান’ আর বসন্ত রাগে গাওয়া ‘ফাগুয়া ব্রিজ দেখনকো’-এই গান দুটিতে খাঁ-সাহেবের গায়নশৈলী বালক ভীমসেনের হৃদয়ে ঢেউ জাগাল, তাঁকে আকুল করে তুলল। এই তো সেই গান, এরকম গানই তো তিনি গাইতে চান। কিন্তু, কে শেখাবেন তাঁকে এমন করে? গুরু কই? নিজের দেশ গদগে তো এমন কেউ আছেন বলে শোনেননি!
এরকম যখন অবস্থা, তখন কার কাছে যেন একদিন শুনলেন গোয়ালিয়রের মহারাজার ‘মাধব সঙ্গীত বিদ্যালয়ে’র কথা। সেখানে নাকি অনেক বড় বড় ওস্তাদ-পণ্ডিত আছেন।...কিন্তু সে যে অনেকদূরের পথ, সবটাই আজানা! তবু একবার মনে আশা জাগে, কোনমতে সেখানে পৌঁছতে পারলে, একটা-না-একটা ব্যবস্থা নিশ্চয়ই হবে। এই আশাটুকু সম্বল করেই মায়ের সঙ্গে অভিমানের ছুতোয় ঘর ছাড়লেন ভীমসেন।
পকেটে একটাও পয়সা নেই। তাই টিকিট কেনা গেল না। বিনাটিকিটেই উঠে বসলেন ট্রেনে। ট্রেন চলতে শুরুকরল।সামনে গোয়ালিয়রের যাত্রাপথ, পাথেয় শুধু সঙ্গীত। গান শুনিয়ে সহযাত্রীদের কাছ থেকে খাবার জুটলেও পদে পদে পড়তে লাগলেন সঙ্গীতরসিক এবং সঙ্গীতবেরসিক টিকিট চেকারদের পাল্লায়। গান শুনে রসিক টি টি সি যাবার অনুমতি দেন তো, বেরসিক টি টি সি পরের স্টেশনে নামিয়ে দেন। তখন আবার অন্য ট্রেনের অপেক্ষা! এভাবেই নামতে নামতে উঠতে উঠতে গোয়ালিয়রে পৌঁছতেই মাস গড়িয়ে গেল।
দক্ষিণ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে ভীমসেনের হাতেখড়ি হয়েছিল বাড়িতেই। মায়ের কাছে ভজন শিখেছিলেন। তাই মহারাজের বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে কোন অসুবিধে হল না। কিন্তু, তিনি যা চান, তা এখানেও পেলেন না। মন যখন তাঁর অতৃপ্তিতে ভরে উঠল, তখনই আলাপ হল ওস্তাদ হাফিজ আলি খান-সাহেবের সঙ্গে।
মহারাজের স্কুলে ছাত্রদের প্রতিদিন দুপুরে ফ্রি-তে খাওয়ানো হত। শুধু সেই দুপুরের খাবারটুকু খেয়েই সারাটা দিন রেওয়াজ করে সন্ধ্যেবেলা ভীমসেন যেতেন হাফিজ আলি খান-সাহেবের কাছে তালিম নিতে। অল্পদিনে এভাবেই তাঁর কাছে দুটি রাগ, 'পূরিয়া' আর 'মারোয়া' শিখে ফেললেন। কিন্তু, ব্যস্ত শিল্পী খান-সাহেব সময় দিতে পারছিলেন না। একদিনশুনলেন কলকাতায় নাকি অনেক বড় বড় সংগীতাচার্য আছেন। সুতরাং, ভীমসেন আবার পথে বেরুলেন গুরুর খোঁজে। আবার ট্রেন।আবার বিনাটিকিটের যাত্রী।এলেন, কলকাতায়।
কলকাতায় তো এলেন। কিন্তু, কোথায় গুরুর খোঁজ করবেন? এদিকে খাবার বলতে কলের জল, ঘর বলতে ফুটপাথ, পকেট দেদার গড়েরমাঠ। এভাবে আর কাঁহাতক পারা যায়! ক্ষিদের জ্বালা সইতে না-পেরে খাবার চেয়ে, যা-হোক একটা কাজ চেয়ে দোরে দোরে ঘুরতে লাগলেন। চেয়েচিন্তে খাবার হয়ত পেলেন, কিন্তু, একটা উটকো ছেলেকে কাজ দেবে কে! শেষে হতাশ হয়ে ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়লেন অভিনেতা পাহাড়ি সান্যালের বাড়ি। ছেলেটির করুণ প্রার্থনা শুনে পাহাড়ি সান্যাল তাঁকে কাজ দিলেনবাড়িতে। ভৃত্যের কাজ। এখানে এসে আহার পেলেন, আশ্রয় পেলেন, কিন্তু, কই গুরু তো পেলেন না! মন উচাটন হল। তখনই কার কাছে যেন শুনলেন, দিল্লিতে ভালো ভালো ওস্তাদ আছেন, ওখানে গেলে নিশ্চয়ই গুরুর সন্ধান পাবেন। সুতরাং, চলো দিল্লি!
দিল্লিতে ওস্তাদের কাছে নাড়া বাঁধতে গেলে টাকা চাই। ভীমসেনের কাছে সেটাই তো নেই। তাই নাড়া বাঁধা হল না। আবার নামলেন পথে। পথ নিয়ে গেল জলন্ধরে। সেখানে গিয়ে ভক্ত মঙ্গতরামজীর কাছে ধ্রুপদ শেখার সুযোগ পেলেন। এখানেই হরিবল্লভ মিউজিক কনফারেন্সে তানপুরা বাজাতে গিয়ে বিষ্ণু দিগম্বরজীর সাক্ষাৎ শিষ্য বিনায়করাও পটবর্ধনের চোখে পড়লেন ভীমসেন। সব শুনে বিনায়করাও বললেন, তুমি যাকে চাইছ, সেই সদগুরু তো তোমার দেশেই আছেন। তিনি ওস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ-সাহেবের সাক্ষাৎ শিষ্য সহায় গন্ধর্বজী। আর সময় নষ্ট না-করে এক্ষুনি তাঁর কাছে গিয়ে নাড়া বাঁধো।
আবার পথ। তবে, সে পথে শুধুই আনন্দ, খুঁজে পাওয়ার ছন্দ। পথ শেষ হল ঘরে। যাঁর গান শুনে, যাঁর মতো গান গাইবার আশায়, যাঁর মতো গুরু পাবার আশায় ভীমসেন হিন্দুস্তানের সঙ্গীত তীর্থের পথে পথে ঘুরেছেন, তাঁরই শিষ্যকে গুরু হিসেবে পাবেন, এর থেকে বড় সৌভাগ্য আর কি হতে পারে! গন্ধর্বজীও যেন এতকাল ভীমসেনের মতো শিষ্যের অপেক্ষাতেই পথ চেয়ে ছিলেন। এমনি করে বিচিত্র জীবনের পথে পথে ঘুরে শেষে ঘরে এসে গুরু-শিষ্যের মিলন হল।