পঞ্চাশে গুগা বাবা

চার পাতার গল্প। ১২০ মিনিটের স্ক্রিন প্লে। মোড় ঘুরিয়ে দিল ভারতীয় শিশু চলচ্চিত্রের। ফ্রেশ গল্প, তুলনামূলক ভাবে অচেনা লেখক, তারকা বর্জিত কাস্টিং, ভিন্ন ধারার মিউজিক, ছকভাঙা কোরিওগ্রাফি, রোমান্স এর ঢেউ নেই, আবেগের বাড়াবাড়ি নেই। তবু সেই সিনেমার টানেই মজে থাকা। এক গেঁয়ো গায়েন আর তার স্যাঙাত বায়েন এর গল্প। সাদা সিধে মাটির মানুষের জিতে যাওয়ার গল্প।  

 

১৯৬৯ এর ৮ মে মুক্তি পেয়েছিল গুপিবাঘা সিরিজের প্রথম ছবি 'গুপি গাইন বাঘা বাইন'। আজকের দিনে। সেই ছবি পঞ্চাশে।

ভাবনার শুরুটা ১৯৬৬-এ। পরিচালক হিসাবে সত্যজিৎ রায় তখন পূর্ণ দৈর্ঘের ১৩ টা সিনেমা করে ফেলেছেন। কাপুরুষ মহাপুরুষ, নায়ক, চিড়িয়াখানা, মহানগর-এর মাধ্যমে  বার্লিন, ভেনিস পৃথিবীর সেরা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালগুলোতে সফল পরিচালকের স্বীকৃতি পেয়েছেন। কিন্তু তবু নতুন ছবির প্রযোজক অধরা।        কেউ গুপিবাঘার শেষটা বদলে তাদের বিয়ে দেবার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ছবিতে খানিকটা রোম্যান্টিক আবহ আনার জন্য। প্রযোজকদের বক্তব্য ছিল ছবির বাজেট নিয়ে। তাঁদের মনে হয়েছিল গুগাবাবা বড় অঙ্কের ছবি। গুগাবাবা ছোটদের ছবি। সেটাও সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শেষ পর্যন্ত পূর্ণিমা পিকচার রাজী হয়। ১৯৬৯ এ মুক্তি পেল গুগাবাবা।

১৯১৫ সালে ‘সন্দেশ’ পত্রিকার পাতায় গুপি গাইন বাঘা বাইন এর প্রথম আত্মপ্রকাশ। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর সৃষ্টি। ১৯৬১ তে সত্যজিৎ রায় তাঁদের ফিরিয়ে আনেন। সন্দেশের পাতাতেই। পরে আসে সিনেমার পরিকল্পনা। সত্যজিৎ রায়ের স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, ১৩ বছরের পুত্র সন্দীপ রায়ের অনুরোধও এই ছবি তৈরি একটা কারণ

গল্পের দুই নায়ক। গুপি আর বাঘা। গুপি গান গাইতে খুব ভালোবাসে। বাঘা ঢোল বাজাতে। কিন্তু তাদের গান বেসুরো । ঢোল বেতালা । রাজামশাই তাদের গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেয়। ঘুরতে ঘুরতে বনের মধ্যে তাদের দেখা হয় ভুতের রাজার সঙ্গে। ভূতের রাজা তাদের তিনটি বর দেন। প্রথম বরে তারা যেমন খুশি খেতে পাবে। দ্বিতীয় বরে  দু’জোড়া জুতো আর হাতের তালিতে তারা যেমন খুশি ঘুরতে পারবে, আর তৃতীয় বরে তারা লোককে গান শুনিয়ে থামিয়ে দেবার ক্ষ্মতা পায়। এরপর দু’জনে শুণ্ডি রাজ্যে গিয়ে রাজাকে গান শুনিয়ে সেখানের সভাগায়কের পদ পায়। শুন্ডির প্রতিবেশি হাল্লা সেই রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে তারা গুপ্তচর হয়ে সেখানে যায়। যুদ্ধবাজ মন্ত্রীকে পরাস্ত করে শান্তি স্থাপন করে। শুণ্ডির রাজকন্যা মণিমালা আর হাল্লার রাজ্যকন্যা মুক্তামালার সঙ্গে তাদের বিয়ে হয়।

চিত্রনাট্য, পরিচালনার সঙ্গে সঙ্গে সিনেমার সবকটি গান তাঁর লেখা। সুরও দিয়েছিলেন তিনি। 

রাজস্থানের দুই বিখ্যাত কেল্লা বুঁদি আর জয়সলমিরে ছবির শুটিং হয়। বলিউডের বিখ্যাত অভিনেতা টিনু আনন্দ এই ছবিতে সত্যজিৎ রায়ের সহকারী পরিচালক ছিলেন। সিনেমায় ভূতের রাজা’র কণ্ঠ সত্যজিৎ রায়ের। বাঘা বাইনের গলার গান বাঘার চরিত্রে অভিনেতা রবি ঘোষের।

সত্যজিৎ রায় গুপি গাইন হিন্দিতে করার কথা ভেবেছিলেন। প্রযোজক হিসাবে শোনা গিয়েছিল রাজ কাপুরের নাম। তাঁর অবশ্য শর্ত ছিল।

কলকাতার হলগুলোতে টানা সাড়ে আটমাস ধরে চলেছিল গুপি গাইন বাঘা বাইন। বক্স অফিসের নিরিখে গুগাবাবা সত্যজিৎ রায়ের সবচেয়ে সফল ছবি। গুগাবাবার সাফল্যের প্রভাব পড়েছিল কলকাতা শহরের মিষ্টির দোকানেও। সিনেমার শেষ ভাগে হাল্লা সেনাদের যুদ্ধ থেকে বিরত করার জন্য গুপি বাঘার গানে আকাশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে নেমে আসা রাজভোগের হাঁড়ি বাজারে রাতারাতি রাজভোগের চাহিদা বাড়িয়ে দিয়েছিল।   

সত্যজিৎ রায় নিজেও খুশি হয়েছিলেন গুগাবাবা’র সাফল্যে। 

 

 

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...