জীবনে প্রথমবার একটা বই চুরি করেছিলেন গুলজার। বইটা রবীন্দ্রনাথের লেখা একটা উপন্যাস, নাম ‘মালঞ্চ’। তখনও তিনি অবশ্য ‘গুলজার’ হননি, মানে ‘গুলজার’ ছদ্মনাম নিয়ে লেখালেখির জগতে আসেননি।
তখন তাঁর বছর চোদ্দ বয়স, সেই বয়সে তাঁকে পাড়ার সবাই বাবা-মার দেওয়া ‘সম্পূরণ’ নামেই জানত, পুরো নাম—‘সম্পূরণ সিং কালরা’। আমরা অবশ্য তাঁকে এই লেখায় বয়স নির্বিচারে ‘গুলজার’ নামেই ডাকব।
যাই হোক, ফিরে আসি বই চুরির কথায়, একটা প্রশ্ন দিয়ে। বইটা গুলজার চুরি করলেন কেন?
আসলে, গুলজারের বাবার ব্যাগ ও টুপির একটা বেশ বড় দোকান ছিল। কিশোর গুলজার স্কুল যাওয়ার আগে আর স্কুল থেকে ফিরে বাবার গদিতে এসে বসতেন। কিন্তু দোকানে বসে বসে সময় কিছুতেই কাটতে চাইত না। তিনি পড়তে ভালোবাসতেন, তাই সেই সময়টায় পড়ার জন্য পাড়ার একটা পুরনো বইয়ের দোকান থেকে ভাড়ায় বই নিয়ে আসতে শুরু করলেন। চার আনা জমা দিলে বই আনা যেত সাত দিন।
রূপকথা, গোয়েন্দা কাহিনি, ডাকাতের গল্প প্রভৃতি কিশোর-উপযোগী যা বই পেতেন; সেগুলো একে একে এনে প্রায় গোগ্রাসে সব পড়ে ফেলতেন। প্রতিদিন একটা করে বই শেষ হয়ে যেত। এসব বইয়ের খুব চাহিদা। তাই দোকানদার রোজ একটা করে বই দিতে দিতে একদা খুব বিরক্ত হয়ে গেল। তখন এমন একটা বই একদিন তাঁকে ধরিয়ে দিল, যেটার তেমন চাহিদা নেই। সেই বইটাই উর্দু অনুবাদে রবীন্দ্রনাথের ‘মালঞ্চ’।
বইটা পড়ে গুলজার যেন সম্মোহিত হয়ে গেলেন। আশ্চর্য হয়ে ভাবলেন, এমনভাবেও গল্প বলা যায়! বইটাকে মনে হল যেন রত্নের খনি। আর ফেরত দিতে ইচ্ছে হল না। ফলে দোকানের দোরই আর মাড়ালেন না।
আসলে, ‘মালঞ্চ’ তাঁর বই পড়ার ধারাটাই বদলে দিল। বুকের ভেতরে জাগিয়ে দিল লেখক হওয়ার বাসনা।
তাই প্রথমেই তাঁর মনে হল, লিখতে হলে এমন লেখাই লিখতে হবে। আর তার জন্য পড়তে হবে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের সমস্ত সাহিত্য। এবং, অবশ্যই তা বাংলা ভাষায়। একসময় গভীর অধ্যবসায়ে শিখেও নিলেন বাংলা। বাংলায় পড়লেন রবীন্দ্র–শরৎ-বঙ্কিম থেকে শুরু করে আধুনিক লেখকদের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যমালা।
রবীন্দ্রনাথকেই জীবনের প্রথম গুরু হিসেবে বরণ করে নিয়েছিলেন গুলজার। সাহিত্যের গুরু। সংস্কৃতির গুরু। রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই তিনি পরিচিত হয়েছিলেন বাঙালিয়ানার সঙ্গে। সেই সূত্রেই পাঞ্জাবি এই মানুষটি আপন করে নিলেন বাঙালির পোশাক, ধুতি আর পাঞ্জাবি।
গুলজার যখন লেখালেখি শুরু করলেন, তখন ভারতীয় গণনাট্য সংঘের বম্বে শাখা, গণতান্ত্রিক লেখক ও শিল্পী সংঘ এবং বম্বে ইয়ুথ কয়্যার প্রভৃতি সংগঠনের বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলেন।
এ-সব সংঘের সঙ্গে সে-সময় জড়িয়ে ছিলেন সলিল চৌধুরি, দেবু সেনের মতো বাঙালি এবং সঙ্গীত-সিনেমা জগতের মানুষেরা। সংগঠনে যাতায়াত করতে করতে এঁদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হল গুলজারের। দেবু সেন একদিন তাঁকে নিয়ে গেলেন বিমল রায়ের মুন স্টুডিওর অফিসে।
বিমল রায় তখন ‘বন্দিনী’ ছবি করবেন। বৈষ্ণব পদাবলীর ভাব নিয়ে একটা গান লিখতে হবে। সমস্যা হল, হিন্দিতে সেই ভাব নিয়ে গান লিখবেন কে? বাংলার বৈষ্ণব ভাব না-জানলে তো আর লেখা যাবে না। এই নিয়ে বিমল রায় বেশ দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।
এই রকম এক পরিস্থিতিতেই দেবু সেন বিমল রায়ের সঙ্গে গুলজারের আলাপ করিয়ে দিলেন। বললেন, বিমল যেভাবে চাইছেন, সেভাবেই গানটি লিখে দিতে পারবেন গুলজার। কথা হচ্ছিল হিন্দিতে। তাই দেবু সেনের দাবি শুনে বিমল রায় অবাক হলেন। সংশয় জাগল, পাঞ্জাবি হয়ে গুলজার কেমন করে সে-গান লিখবেন! তাই দেবু সেনকে বললেন বৈষ্ণব পদাবলীর ভাব ভালো করে বুঝিয়ে দিতে। দেবু সেন হেসে জানালেন, তার দরকার হবে না। কারণ গুলজার বাংলা ভাষাটা ভালো জানেন তো বটেই, এমনকি বাংলা সাহিত্যও বলতে গেলে তিনি প্রায় গুলে খেয়েছেন!
সে-কথা শুনে বিমল রায় অবাক হলেও, সেই অবাকভাবটা কাটতে দেরি হল না। কারণ, এর পর তাঁদের মধ্যে যা বাৎচিত হল, সমস্তই হল নির্ভেজাল বাংলাতে।
ফলত, বিমল রায়ের চাহিদামতো গুলজার লিখলেন ‘বন্দিনী’ সিনেমার জন্য-‘মোরা গোরা অঙ্গ’ গানটি।
গানটি তো লেখা হল। কিন্তু সুরকার শচীন দেব বর্মণ বললেন যে, তাঁর প্রিয় গীতিকার শৈলেন্দ্র গান লিখবেন, নতুন কারও সঙ্গে তিনি কাজ করবেন না। বিমল রায় তো পড়লেন মহা মুস্কিলে। অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শেষ পর্যন্ত ‘মোরা গোরা অঙ্গ’ গানটি ছবিতে রাখার ব্যবস্থা করা গেল। কিন্তু বাকি গানগুলো লেখার বরাত আর গুলজার পেলেন না, লিখলেন শৈলেন্দ্র।
বরাত না পান, ‘বন্দিনী’র গানটি লিখে গুলজারের বরাত কিন্তু খুলে গেল। ওই এক গানেই আপন প্রতিভার পরিচয় দিয়ে তিনি বিমল রায়ের দারুণ প্রিয় হয়ে উঠলেন। বিমল তাঁকে হারিয়ে যেতে দিলেন না। পরের ছবি ‘কাবুলিওয়ালা’তে সহকারী পরিচালক হিসেবে দলে নিয়ে নিলেন। হাতে ধরে শেখালেন সিনেমা তৈরির খুঁটিনাটি। ইনি গুলজারের জীবনে দ্বিতীয় গুরু। সিনেমার গুরু।
বিমল রায়ের সঙ্গে কাজ করতে করতে একদিন রাহুল দেব বর্মণের সঙ্গে তাঁর আলাপ হল। রাহুল তখন বাবার সহকারী। গুলজার আর রাহুলের বন্ধুত্ব হতে বেশি দেরি হল না। দুজনেরই তখন নতুন কিছু করে দেখানোর প্রবল উৎসাহ। গুলজারের প্রথম ছবি ‘মেরে আপনে’-তে সলিল চৌধুরি সুর দিলেও ‘পরিচয়’ ছবি থেকে গুলজার-রাহুলের পথ চলা শুরু হয়ে গেল। গুলজারের ছবি, গুলজারের কথা, রাহুলের সুর। সৃষ্টি করল ইতিহাস।
সেই ইতিহাস তো এখন অভাবনীয় সৃষ্টিশীলতায় কিংবদন্তি। এই যুগলবন্দির মধ্যিখানে রাহুল যেমন অন্যের ছবিতে সুর দিলেন; গুলজার তেমনি হৃষীকেশ মুখার্জির জন্য স্ক্রিপ্ট লিখলেন, হেমন্ত মুখার্জি, শচীন দেবের সুরে গান লিখলেন। জুড়ে রইলেন বলিউডের বাঙালি পরিমণ্ডলটির সঙ্গে। বিয়েও করলেন বাংলার মেয়ে রাখীকে।
রবীন্দ্রনাথ গুলজারের মনে যে বাঙালিয়ানার বীজ বুনে দিয়েছিলেন, কর্মসূত্রে ও ব্যক্তিজীবনে ক্রমাগত বাঙালি-সাহচর্য তাঁর সেই বাঙালিয়ানাকে দিনে দিনে আরও সমৃদ্ধ করেছে। শেকড় না-ভুলেও তাকেই জীবনের অচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে বরণ করেছেন গুলজার। আর তারই জন্য আজও অশীতিপর এই মানুষটির চোখের সামনে ভাসে সেই কবেকার বাঁক বদলের ‘মালঞ্চ’, তার ধূসর প্রচ্ছদ, প্রচ্ছদ পেরিয়ে উজ্জ্বল বর্ণমালা...