নেপালের সতীপীঠের জাগ্রত দেবী ‘গুহ্যেশ্বরী’

নেপালের ‘কাঠমাণ্ডু’র কথা বললেই ভক্তজনের হৃদয়ে জেগে ওঠে সুবিখ্যাত এক শৈবতীর্থের কথা, সেটি হল সুরম্য বাগমতী নদীর তীরে অবস্থিত ‘পশুপতিনাথ মন্দির’। এখানে এসে শিবের অতীব মনোরম আরতি দর্শন করেননি, এমন ভক্তও বিরল। কিন্তু অনেক ভক্তজনই খোঁজ রাখেন না যে, এখানেই রয়েছে দেবী সতীর অষ্টম পীঠ। ‘পশুপতিনাথ’ শিব আসলে সেই দেবীর ভৈরব। দেওঘরের সতীপীঠ যেমন ভৈরব বৈদ্যনাথের নামে জনপ্রিয়, কাঠমাণ্ডুর এই পীঠভূমিও ভৈরব পশুপতির নামে বিখ্যাত। দেবী সতীর পীঠ সাধারণের কাছে পশুপতির মহিমায় কিছুটা উপেক্ষিত রইলেও মাহাত্ম্যের আধারে তান্ত্রিকসাধকদের কাছে এই পীঠ আকর্ষণের কেন্দ্র। তন্ত্রমাহাত্ম্য আলোচনার পূর্বে এই পীঠপরিচিতির কিংবদন্তিটুকু বরং আগে বলে নিইঃ

guhyeshwari (1)

কাহিনির শুরু মারোয়ার দেশে। সেই দেশ ছিল রাজা সুদন্তের রাজ্য। তাঁর শাসনে প্রজারা বেশ সুখেই বাস করত। কিন্তু রাজা সুদন্তের মনে কোন সুখ ছিল না। কোন কারণে রানি পিঙ্গলার সতীত্বের ওপর তাঁর অহেতুক অবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল। সেই অবিশ্বাসের আগুনে দিনরাত জ্বলতে জ্বলতে তিনি একসময় আর সহ্য করতে পারলেন না। অবিশ্বাসের মূল অনুসন্ধান না-করেই অন্যায় করে বসলেন। অপমান করে পিঙ্গলাকে অন্তঃপুর থেকে তো বটেই রাজ্য থেকেও দূর করে দিলেন। অভিমানে রানি যেদিকে দু’চোখ যায় হাঁটতে লাগলেন। কত দিন কত রাত হাঁটতে হাঁটতে তিনি একদিন পৌঁছে গেলেন নেপাল প্রদেশে। 

পিঙ্গলা রাজকন্যা, সাধারণ গেরস্ত নারীর মতো মনেপ্রাণে দুর্বল ছিলেন না। কিন্তু চরিত্রের প্রতি মিথ্যে সন্দেহে সকলের সামনে যেভাবে অপমান করে রাজা তাঁকে ত্যাগ করেছিলেন, সেটা তাঁকে অত্যন্ত আঘাত করেছিল। তাতেই তাঁর নিজেকে বড় একা বলে মনে হয়েছিল। আশ্রয় নিয়েছিলেন ইষ্টদেবী শক্তির চরণে। রাজার ঘরণী পিঙ্গলা এক বস্ত্রে পায়ে হেঁটে ক্ষুধা-পিপাসায় কাতর হয়ে যেভাবে তাঁকে সর্বদা স্মরণ করেছেন, তাতেই পেলেন তপস্যার ফল। 

দেবী তুষ্ট হয়ে তাঁকে দেখা দিলেন স্বপ্নে। বললেন, দুঃখ করিস না বাছা, আমার ইচ্ছায় তোর সব কষ্ট দূর হবে। সুখে বড় হয়েছিলি, এখন সংসারে দুঃখ পেয়েছিস, আবার সুখ আসবে। সুখ-দুঃখ-সুখ, সব মিলিয়েই তো জীবন। আমার কৃপায় তুই তার মধ্যে সেতু বাঁধতে শিখবি। নিকটেই বাগমতী নদীতীরে আমার গুপ্তথান রয়েছে, তুই তা অনুসন্ধান করে আমার পূজা করবি। তাতে আবার স্বামীসোহাগ ফিরে পাবি। মনে রাখবি, আমি সেখানে সতীর দেহাংশে গুহ্যেশ্বরীরূপে বিরাজ করছি।

স্বপ্ন ভাঙতেই ধড়মড় করে উঠে বসলেন পিঙ্গলা। পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে পার্বত্য অরণ্যের এক নির্জন বৃক্ষমূলে মাথা রেখে তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। আর স্থির থাকতে পারলেন না। দেবী তাঁকে আদেশ দিয়েছেন! শুরু করলেন বেগবতী নদীর সন্ধান। পাহাড়-অরণ্যে খুঁজতে খুঁজতে এক সময় শুনতে পেলেন পাহাড়ি নদীর কলধ্বনি। হ্যাঁ, বেগবতীই বটে; খরস্রোতে বয়ে চলেছে সে। তার পাড় ঘিরেই ভক্ত শুরু করলেন ভগবতীর অনুসন্ধান। কিন্তু কোথায় সে পীঠ! দেবী তো তাঁকে সেই পীঠস্থান খুঁজে পাবার মতো কোন চিহ্নের কথা বলে দেননি। পিঙ্গলা তাহলে কীভাবে চিনবেন সেই পীঠ! এই সংশয়ের মাঝেও দেবীর প্রতি অচলা ভক্তিতে পিঙ্গলা ভাবলেন, দেবী যখন ভার দিয়েছেন, তখন নিশ্চয় উদ্ধার তিনিই করবেন। হলও তাই। বাংলার রামপ্রসাদকে দেবী বেড়া বাঁধতে সাহায্য করেছিলেন; মারোয়ার রানি পিঙ্গলাকে তিনি পীঠ খুঁজে দিতে এগিয়ে এলেন।

চারিদিক অনুসন্ধান করতে করতে এক সময় হঠাৎ পিঙ্গলা দেখলেন একটি কৃষ্ণকায় নিরাবরণা দৈবী কুমারী আলোর দ্যুতির মতো আবির্ভূতা হয়েই নিকটের ঝোপের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। পিঙ্গলা ভক্তিমতী বুদ্ধিমতী নারী। তিনি ইশারা বুঝলেন। ভক্তের আকুতি নিয়ে পৌঁছে গেলেন অদৃশ্য হওয়ার স্থানটিতে। ঝোপঝাড় পরিষ্কার করতেই দেখতে পেলেন পাথরের বুকে নারীদেহের জন্মদ্বারের মতো দেখতে এক গর্ত। তাতে ভরে আছে জল। পিঙ্গলা বুঝতে পারলেন ‘গুহ্যেশ্বরী’ কথার অর্থ। ‘গুহ্য’ কথার অর্থ, ‘যোনি’। আর সেই রূপে অধিষ্ঠাত্রী দেবীই হলেন ‘গুহ্যেশ্বর’'। পিঙ্গলা গর্তের জল ভক্তিভরে মাথায় নিয়ে বুনো ফুল দিয়ে যথাবিহিত পুজো করলেন দেবীর। তারপর দেবীর থানই হয়ে উঠল পিঙ্গলার বাসস্থান; দেবী তাঁর হাতেই পেতে লাগলেন নিত্য পুজো। এমনি করেই দিন কাটতে লাগল।

ওদিকে ধীরে ধীরে রাজা সুদন্তের মনে ভাবান্তর ঘটতে লাগল। দেবীর কৃপায় তিনি বুঝতে পারলেন যে, অন্তঃপুরের কানাঘুষো শুনেই তিনি রানিকে অবিশ্বাস করেছেন; কই কোনদিন তো রানিকে ডেকে তার সত্যতা যাচাই করেননি! বরং তাঁকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছেন! বড্ড ভুল হয়ে গেছে! দেবীর কৃপায় এও বুঝতে পারলেন যে, পিঙ্গলা সত্যিই নির্দোষ। আর এই বোধোদয় হতেই রাজা অধীর হলেন পিঙ্গলাকে ফিরে পাবার জন্য। কিন্তু তিনি যে কোথায়, তা তো কেউই জানে না! আদৌ তিনি বেঁচে আছেন কি না কে জানে!—এসব ভাবতে ভাবতে রাজা দারুণ অনুশোচনায় ভেঙে পড়লেন। এই সময় দেবী রাজার সহায় হলেন। স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলে দিলেন রানির ঠিকানা।

পরদিন সকালেই রাজা পিঙ্গলার খোঁজে পাড়ি দিলেন। বহুদিন ধরে বহু ক্লেশ সয়ে দেবীর দেখানো পথে অবশেষে তিনি বেগবতীর তীরে গুহ্যেশ্বরীর থানে এসে খুঁজে পেলেন পিঙ্গলাকে। দুঃখ আর অনুশোচনার আগুনে দুজনেই শুদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন। এবার মিলনের সুখে বিভোর হলেন। দু’জন দু’জনকে পেয়ে আনন্দে অধীর হলেন। পাড়ি দিলেন রাজধানীর উদ্দেশ্যে। তবে ফেরার আগে দেবীর থানটি সুরম্য বেদিতে বাঁধিয়ে দিয়ে গেলেন। সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন দেবীর কৃপা, দেবীর পরশ আর শিলাগর্তের পবিত্র জল। দেশে ফিরে দেবীর কৃপায় তাঁরা সুখে দিন কাটাতে লাগলেন। 

তারপর কত কত কাল কেটে গেল। সুদন্তের বাঁধানো বেদি নষ্ট হয়ে গেল। দেবীর থান আবারও ভরে উঠল বন্য গাছগাছালিতে। কালের পরতে ঢাকা পড়ে গেল জাগ্রত পীঠভূমি। দেবী প্রস্তুত হলেন আরেক লীলার জন্য।

সময়টা সতের শতক। তখন নেপালের রাজা প্রতাপমল্ল। এক তান্ত্রিক এই সময় ঘুরতে ঘুরতে নেপালে এসে তাঁর আতিথ্য গ্রহণ করেন। রাজা তান্ত্রিকের দৈবীগুণের পরিচয় পেয়ে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তান্ত্রিক রাজার আতিথ্যে থাকতে থাকতেই এক সময় অনুভব করতে শুরু করেন যে, এই ভূমিতে দেবী শক্তি জাগ্রতা হয়ে রয়েছেন। রয়েছেন ভক্তের পূজা পাবার আকাঙ্ক্ষায়। ধ্যানস্থ হয়ে তিনি সে ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে রাজাকে জানালেন সে কথা। এও বললেন যে, দেবী বেগবতীতীরেই গুপ্তপীঠে অবস্থান করছেন। ভক্ত তাঁকে অনুসন্ধান করে পুজো করবেন, এটাই সেই লীলাময়ীর ইচ্ছা। ব্যস, একথা শুনে ঈশ্বরীর ইচ্ছেকে মর্যাদা দিয়ে রাজা সদলে শুরু করলেন দেবীপীঠের অনুসন্ধান। সকলের ঐকান্তিক ইচ্ছায় খুঁজে পেলেন দেবীর গুপ্তপীঠ।

রাজা চারিদিক পরিষ্কার করে তান্ত্রিক যন্ত্রের আকারে দেবীর জন্য সেখানে তিনকোণা এক মন্দির নির্মাণ করে দিলেন। সিংহসহ মন্দিরে দেবীর প্রতীক এক শিলামূর্তি প্রতিষ্ঠা করলেন। এই মূর্তিতে দেবী বিশ্বরূপীণী ও সহস্রবাহু। রাজা মন্দিরের মাথায় স্থাপন করালেন চারটি পেতলের সর্পমূর্তি। এই মূর্তিগুলিও তান্ত্রিক আচারের প্রতীক। নানান কারুকার্যে শোভিত করলেন মন্দিরের গা। আর আদি যে যোনিশিলা, তাকে বাঁধিয়ে দিলেন চারকোনা এক চাতালে। যোনিশিলার মুখ ঢেকে দিলেন ধাতুময় এক পর্দায়। পর্দা সরিয়ে সঞ্চিত জল মাথায় নিয়ে দেবীর আশীর্বাদ গ্রহণের চল শুরু হল। শুরু হল নিত্য পুজোর পরিসর। কালক্রমে নবরাত্রি ও বিজয়া উৎসবে এই পীঠস্থানে বিশেষ পুজোর আয়োজন শুরু হল। শুরু থেকেই মন্দিরটি তান্ত্রিকসাধকদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ শক্তিভূমি বিবেচিত হয়ে আসছে। আদি থেকে আজ পর্যন্ত নিয়মিত বিভিন্ন তান্ত্রিক ক্রিয়াও অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে এখানে।

দেবী গুহ্যেশ্বরীর এই পীঠটি পশুপতিনাথ মন্দিরের এক কিলোমিটারের মধ্যে বাগমতী নদীতীরের শ্মশানের কাছে অবস্থিত। দেবী এখানে কালীরূপে পূজিত হন। ‘গুহ্যকালী’ বা ‘গুহ্যেশ্বরী’ নামে তিনি আপামরের কাছে পরিচিত। কিন্তু বিভিন্ন তন্ত্র ও শাস্ত্রগ্রন্থে তাঁর প্রকৃত নাম ও ভৈরবের নাম নিয়ে মতান্তর রয়েছে। ‘পীঠনির্ণয়তন্ত্র’ মতে এখানে দেবী সতীর জানু অর্থাৎ হাঁটু পতিত হয়েছিল। দেবীর নাম, ‘মহামায়া’; তাঁর ভৈরবের নাম, ‘কপালী’। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দেবীকে এখানে ‘যোনি’ প্রতীকে পূজার কারণ কী?

আমরা সবাই জানি যে, শাস্ত্রমতে দেবী সতীর যোনি পতিত হয়েছিল কামাখ্যায়। দেবী সেখানে যোনিপ্রতীকে পূজিত হন। আমরা জানি যে, কামাখ্যা তান্ত্রিকসাধনার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পীঠস্থান। ইতিহাস বলে যে, নেপালেও তন্ত্রসাধনা এক সময় ব্যাপকভাবে চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছিল। অনেকে তাই মনে করেন যে, সিদ্ধপীঠ কামাখ্যার অনুকরনে নেপালেও একটি যোনিপীঠ গড়ে তোলা হয়েছিল। আর সেটিই হচ্ছে এই ‘গুহ্যেশ্বরী’ পীঠ। পরবর্তীতে তার সঙ্গে জুড়ে গেছে যোনিপতনের মিথকথা। তাতে ‘জানু’ হয়ে গেছে ‘যোনি’।

যাই হোক, দেবী যেভাবে যে রূপেই থাকুন না কেন; অনাদিকাল থেকে আজও তিনি বেগবতীতীরের সতীপীঠে মাতৃময়ী হয়ে ভক্তের পুজো গ্রহণ করে দান করে চলেছেন শান্তির আশ্রয়...             

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...