ভুট্টা যেমন অত্যন্ত পুষ্টিকর একটি খাবার, তেমনি বেশ সুস্বাদুও বটে। কচি থেকে পাকা, যে-কোন অবস্থাতেই ভুট্টা দিয়ে নানান ব্যঞ্জন বা খাবার তৈরি করা যায়। বাজারে কচি ও কাঁচা ভুট্টা যেমন সহজে পাওয়া যায়, তেমনি পাওয়া যায় পোড়া ভুট্টাও। এ তো আমাদের জানা ব্যাপার। কিন্তু আমরা হয়তো অনেকেই জানি না যে, ভুট্টা খুব সহজেই সাধের ছাদ বা ব্যালকনি বাগানে ফলানো যায়। সহজে মানে, খুব সহজে। শীতে এবং গ্রীষ্মে—এই দুই সময়ই ভুট্টা চাষ করা যায়। শীতে চাষ করতে হলে, এই সপ্তাহের মধ্যেই ভুট্টার দানা বসিয়ে ফেলুন, একদম আর দেরি করবেন না। আর গরমে চাষ করতে চাইলে ফেব্রুয়ারি-মার্চে বীজ বসাবেন। যেখান থেকে বীজ কিনবেন, সেখান থেকে হাইব্রিড জাতের বীজ নেবেন। আর বীজটি যে সময়ে চাষ করতে চান, সেই সময়ের উপযোগী কি-না এটাও যাচাই করে জেনে নেবেন। ও হ্যাঁ, মাথায় রাখবেন, ভালো ভুট্টা পেতে গেলে কিন্তু ছাদ বা ব্যালকনি বাগানে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা ভালো রোদ থাকতে হবে।
ভুট্টা সব ধরণের মাটিতেই চাষ করা যায়। তবে, দোআঁশ মাটিতে সবচেয়ে ভালো হয়। তাই আপনার কাছে যদি দোআঁশ মাটি থাকে, তাহলে সেই মাটি সত্তর ভাগ নিয়ে তার সঙ্গে তিরিশ ভাগ ভার্মি কম্পোস্ট বা এক বছরের পুরনো গোবর সার মিশিয়ে মাটির উর্বরতা বাড়িয়ে নিন এবং ভুট্টা চাষের উপযোগী করে নিন। আর যদি আপনার কাছে এঁটেল মাটি থেকে থাকে, তাহলে এই মাটি দেড় ভাগ নিয়ে তার সঙ্গে দেড় ভাগ বালি এবং এক ভাগ ভার্মি কম্পোস্ট বা এক বছরের পুরনো গোবর সার মিশিয়ে উর্বর দোআঁশ মাটি তৈরি করে ফেলুন। আমি ভুট্টা চাষ পলিব্যাগে করি। আপনারা যদি পলিব্যাগে চাষ করতে চান, তাহলে প্রথমে মুদি দোকানে পাঁচকেজি পরিমাণ মালপত্র দিতে যে গোল মুখওয়ালা পলিব্যাগ দেয় বা তার সমান আকারের পলিব্যাগের অর্ধেকটা মাটি দিয়ে ভর্তি করে নিন। তারপর ওপরের অংশটা ফুলহাতা জামার হাতা গুটানোর মতো করে মাটির দেড় ইঞ্চি ওপর পর্যন্ত গুটিয়ে দিন। এতে পলিব্যাগের গাছে জল দিতে খুব সুবিধে হয়। পলিব্যাগের জলনিকাশি ব্যবস্থা হিসেবে ব্যাগের তলায় চারপাশে পেরেক দিয়ে দুটো করে আটটা ফুটো করে দেবেন। আর যদি আপনি টবে ভুট্টা চাষ করতে চান, তাহলে দশ বা বারো ইঞ্চি টব ব্যবহার করবেন এবং জলনিকাশি ব্যবস্থা ঠিক রেখে টবের আশিভাগ অংশ মাটি দিয়ে ভর্তি করে নেবেন। ভুট্টা গাছ গোড়ায় জল জমে থাকা পছন্দ করে না, তাই উভয়ক্ষেত্রেই জলনিকাশি ব্যবস্থা ঠিক রাখতে হবে।
দোকান থেকে যে বীজ এনেছেন, তাতে দেখবেন লাল বা সবুজ রঙ মাখানো। এগুলো আসলে ফাঙ্গিসাইডের রঙ। বীজ যাতে ছত্রাকে ও পোকায় নষ্ট করতে না-পারে, তার জন্য বীজ প্যাকেটজাত করার আগে তাতে বিষ ও ছত্রাকনাশক মাখিয়ে দেওয়া হয়। ভুট্টা গাছে যে সমস্ত রোগবালাই হয়, তার বেশিরভাগটাই হয় ছত্রাকের কারণে। তাই এবিষয়ে আমাদের সাবধান থাকতে হবে। বীজ টব বা পলিব্যাগে রোপণের আগে বারো থেকে কুড়ি ঘন্টা সেগুলো জলে ভিজিয়ে রাখতে হবে। তারপর বীজগুলো জল থেকে তুলে এক কাপ জলে এক চিমটে ফাঙ্গিসাইড গুলে সেই জলে আরও আধঘন্টা চুবিয়ে রাখতে হবে। এভাবে বীজ শোধন করে নিলে চারায় ছত্রাকের আক্রমণ আর কিছুতেই হবে না। ফাঙ্গিসাইড মেশানো জল থেকে তুলে এরপর এক-একটি সুস্থ-সবল বীজ এক-একটি টবে বা পলিব্যাগে আধ ইঞ্চি মাটির নীচে পুঁতে দিতে হবে। বীজ পোঁতার পর যথেষ্ট জল দিয়ে টব বা ব্যাগের মাটি ভালো করে ভিজিয়ে দিতে হবে। রেখে দিতে হবে ফুল সানলাইটে। মাটি না-শুকিয়ে এলে এই সময় আর জল দেবার প্রয়োজন নেই। এতেই দিন সাতেকের মধ্যে মাটি ফুঁড়ে ভুট্টার চারা বেরিয়ে আসবে।
ভুট্টার চারার বয়স দশ-পনেরো দিন হলেই খাবার দেওয়া শুরু করবেন। খাবার দেবার কোন বাঁধাধরা পদ্ধতি নেই। তবু দুটো পদ্ধতি বলছি, যেটা আপনার সুবিধে হবে, অ্যাপ্লাই করবেন; আবার মিলিয়ে মিশিয়েও করতে পারেন। সবটাই আপনার সুবিধে অনুযায়ী করবেন। এবার পদ্ধতিগুলো বলিঃ
ক. জৈব পদ্ধতিঃ প্রতি সপ্তাহে অলটার করে সরষের খোলপচা ও সবজির খোসাপচা জল দেবেন। দেবার সময়, তিনদিনের খোলপচা জল পাতলা করে অর্থাৎ এক মগ খোলপচা জলের সঙ্গে দশ-বারো মগ সাধারণ জল মিশিয়ে দেবেন। আবার পনেরো দিনের সবজিপচা জল দেবার আগে, এক মগের সঙ্গে ছ’মগ সাধারণ জল মিশিয়ে পাতলা করে দেবেন।
খ. রাসায়নিক এনপিকে সার দেবার পদ্ধতিঃ রেডিমেড দশঃছাব্বিশঃছাব্বিশ প্রতি দশ দিন অন্তর প্রতি টব বা ব্যাগে গাছের গোড়া থেকে দূরে আট-দশ দানা করে দেবেন। অথবা, ইউরিয়া এক কাপ, পটাশ দু’কাপ এবং গুঁড়ো ফসফেট আট কাপ অনুপাতে একসঙ্গে মিশিয়ে প্রতি টব বা ব্যাগে এক বা দেড় চা-চামচ করে দেবেন গাছের গোড়া থেকে দূরত্ব বজায় রেখে।
এছাড়া এর সঙ্গে মাসে দু’বার টব বা ব্যাগ প্রতি চার-পাঁচ দানা করে ডিএপি সার দেবেন। মাসে এক বার গোবর বা ভার্মি কম্পোস্ট দু’মুঠো করে দেবেন গাছের গোড়ায়।
গাছের মাটি কখনই খটখটে শুকনো হয়ে যেতে দেবেন না। নিয়মিত জল দেবেন। টবে বা ব্যাগে আগাছা হতে দেবেন না। আর প্রতি পনেরো দিন অন্তর নিয়ম করে এক লিটার জলে এক গ্রাম ফাঙ্গিসাইড মিশিয়ে প্রতিটি গাছে স্প্রে করবেন। কেননা, আগেই বলেছি এ গাছের প্রধান শত্রু হল ছত্রাক। আমার দোতলার ছাদবাগানে দু’বছর ভুট্টা চাষের অভিজ্ঞতায় দেখেছি অন্য কোন পোকা বা রোগের আক্রমণ একেবারেই হয়নি। আশা করি আপনাদেরও হবে না। তাই তার প্রতিকার বিষয়ে কিছু লিখছি না।
ভুট্টার ফল আসতে কমপক্ষে দু’মাস সময় লাগে। ফল পাকতে তিন মাস। ভুট্টা গাছে এই ফল আসার সময় অসাধারণ সুন্দর মঞ্জরী আসে। আর ভুট্টার ফলের মাথায় দেখা যায় অদ্ভুত সুন্দর রেশমের সুতোর মতো গোছা। ফলত, ভুট্টা গাছ আপনাকে শুধু পুষ্টিকর ফলই উপহার দেবে না, ফুল ও ফলের বাহারে বাগানকে সাজিয়েও তুলবে। তাই বলছি, আর দেরি না-করে কালই শীতের ভুট্টা চাষ করার কাজে লেগে পড়ুন আর ফুলে-ফলে সাজিয়ে তুলুন আপনার সাধের বাগান।।...