বিরহী শিবের তপভূমি বিরোহী

সারা বছর একঘেয়ে সময় কাটিয়ে পুজোর সময় বেড়াতে গেলে ক্লান্তি উধাও হয়ে যায়। আসলে পুজোর সময় ছাড়া আমার কর্তা বড় ছুটি পান না। তাই পুজোর সময়ই আমরা বেড়াতে যাই।

২০১০ সালেও পুজোর সময় বেরিয়ে পড়ার ব্যবস্থা আগে থেকেই করা। সেবার আমরা বদ্রি নারায়ণ গেলাম। সঙ্গী তখন অনেকে। আমার ভাসুর তার পরিবারের তিনজন, আমার দেওর তার পরিবারের দুজন এই নিয়ে সদস্য সংখ্যা দাঁড়ালো মোট দশজন। তবে আমরা হয়ত পঞ্চমীর দিন রওনা হয়েছিলাম আর দেওর পরের দিন।

আমরা আগে গিয়ে ঋষিকেশে বিশ্রাম নিতে থাকি ওরা একদিন পর চলে আসে। এরপরই শুরু হয় যাত্রা আর সঙ্গে ভ্রমণ। সেবারে আমরা একটু অফবিট স্পট  পছন্দের তালিকায় রেখেছিলাম। ঋষিকেশ থেকে বিরোহী বা বিরেহি। ওখানেই প্রথম বিশ্রাম নেওয়ার জন্য নির্বাচন করি।

 

birahi1

বিরোহী ঋষিকেশ থেকে বদ্রি নারায়ণের দূরত্ব ৩০৭ কিলোমিটার। এই যাত্রাপথ অতিক্রম করতে সময় লাগে প্রায় বারো থেকে চৌদ্দ ঘন্টা। পাহাড়ি পথ তীব্র থেকে তীব্রতর  চড়াই। তাই একবারে  বদ্রি নারায়ণ না গিয়ে মাঝপথে একটু বিশ্রাম নেওয়া। একটা বড়ো গাড়ি নেওয়া হয়েছে তাতে আমরা দশজন। কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি পাহাড়ের পাকদন্ডী বেয়ে উঁচুতে উঠতে শুরু করে। এরপর শুধু পাহাড় আর পাহাড়। নানা রঙের প্রকৃতি সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চলা। সেবার পুজো শুরু হয়েছিল বাইশে অক্টোবর। অক্টোবরের শেষদিকে পাহাড়ে শীতের মরসুম।

যদিও কলকাতাবাসীদের শীত আর পাহাড়ের শীত এক নয়। অক্টোবরের শেষদিক বলে পাতা ঝরার মরসুম শুরু হয়ে গেছিল। আর পাহাড়ের সবুজ ঘাস তখন হিমেল ঠান্ডার স্পর্শে শুকিয়ে অনেকটা ম্যাড়ম্যাড়ে সবুজ।

ঠিক আগের বছর যেখানে আমরা ঘন সবুজ বনানী দেখতে দেখতে এগিয়ে গিয়েছিলাম। প্রকৃতির আসল রং রূপ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম পরের বছর অর্থাৎ ২০১০-এ কিন্তু পাহাড়ের অন্যরূপ দেখে যেমন অবাক হয়েছি তেমনি মুগ্ধও হয়েছি। শীতকালে শীতের দেশ দেখার আলাদা মাধুর্য আছে।

ক্যানভাসে যেমন রং তুলি দিয়ে নানা রং একে রঙিন করা যায় প্রকৃতি ও তার ক্যানভাস কে নানা রঙে সাজিয়ে তোলেন আপন খেয়ালে।

বইতে পড়েছিলাম পর্বতমালার সংজ্ঞা। বাস্তবে আমি বদ্রি নারায়ণ যাওয়ার পথে পর্বতমালার সঙ্গে পরিচিত হলাম। ধ্যান গম্ভীর, সুউচ্চ শৃঙ্গ শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়ে আছে। কারুর মাথা ঘন সবুজ কেউ বা বরফের মুকুট পরে দাঁড়িয়ে।একের পর এক পর্বতমালা অতিক্রম করে এগিয়ে যাওয়া সঙ্গে গাছ, পাখি, ফুল আর প্রকৃতির অবিশ্বাস্য পরিবর্তন চোখে দেখে মুগ্ধ দৃষ্টিতে অবলোকন করে মন ক্যামেরায় বন্দি করছি।

 

birahi2

 

দেবপ্রয়াগ, কর্ণ প্রয়াগ পেরিয়ে রুদ্রপ্রয়াগ পৌঁছতে প্রায় দুপুর গড়িয়ে বিকেল। পাহাড়ে সন্ধ্যে নামে তাড়াতাড়ি। অন্ধকারে গাড়ি চলে না। অন্ধকারে পাকদন্ডী রাস্তায় ভ্রমণ আর মৃত্যুকে ডেকে আনা  সমার্থক। তাই গাড়ি চলেছে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য। সঙ্গী অলকানন্দা যে আপন গতিতে বয়ে চলেছে যুগ যুগ ধরে। পাহাড়ের নৈঃশব্দ, অলকানন্দার কলকল ধ্বনি, আর পাতার ফিসফাস সঙ্গে নিয়ে নিঝুম পাহাড়ের বুক চিরে আরও এগিয়ে চলেছে।

রুদ্রপ্রয়াগের পর চামোলি শহর। চামোলি শহর থেকে সাত আট কিলোমিটার উত্তর পূর্বে বিরোহী । আমাদের গন্তব্য এবং বিশ্রামস্থল। অলকানন্দার উপরে গাড়োয়াল বিকাশ মন্ডল নিগমের কটেজ যেখানে রাত্রিবাস করব আমরা।

গাড়োয়াল বিকাশ মন্ডল নিগমের ট্যুরিস্ট স্পট একটু লোকালয়ের বাইরে হয় আর প্রকৃতিকে উপভোগ করা যায় এমন স্থানই নির্বাচন করে ওরা। বিরোহী তে আর কোনও থাকার ব্যবস্থা নেই।

আমরা বেশ রাতের দিকেই পৌছালাম হয়তো ঘড়িতে তখন সাতটা বা সাড়ে সাতটা হবে। পাহাড় এই সময় কুয়াশা আর অন্ধকারকে সঙ্গে নিয়ে নিঝুম চাদরের নীচে লুকিয়ে পড়ে। বিজলি বাতির আলো গারোয়ালের প্রত্যন্ত পথে আশা করা বাতুলতা। অন্ধকারের চলতি পথে থাকে অজস্র বাঁক, পাকদন্ডী, চড়াই, নৈঃশব্দ, পাতার ফিসফাস নদীর ক্রমাগত বয়ে চলার কলকল ধ্বনি আর পাহাড়ে গাড়ি চলার প্রতিধ্বনিত গোঁ গোঁ শব্দ যা কানের শ্রবণ ক্ষমতা কিছুসময়ের জন্য নষ্ট করে দেয়।

অবশেষে আমরা আমাদের নির্বাচিত বিরোহী তে এসে পৌঁছলাম। ঘর পেতে যা সময় লাগল। এরপর আমরা আমাদের ঘর পেলাম।

যেমন ভেবেছিলাম পাহাড়ের প্রত্যন্ত এলাকায় সাদামাটা ঘর পাবো ঘরে ঢুকে ধারণা সম্পূর্ণ পাল্টে গেল। ঠিক অলকানন্দার উপর আমাদের ঘর। জানালা খোলা গেল না রাত্রিবেলা। বিশাল ঘর সম্পূর্ণ মোটা কার্পেট এর মোড়া। দু’খানা ছয় বাই সাতের খাট পুরো মোটা গদি দিয়ে মোড়া আর চারখানি নরম পশমের কম্বল রাখা। একটি ছোট ঘর যেখানে ব্যাগ ব্যাগেজ রাখার ব্যবস্থা সঙ্গে প্রসাধন করারও ব্যবস্থা রয়েছে।

 

birahi3

 

দুটি টয়লেট দুই ধরণের। সব মিলিয়ে একে স্যুইট বলা চলে। দীর্ঘ পথ পরিভ্রমণ করে ক্লান্ত শ্রান্ত আমরা। প্রত্যন্ত এলাকা বিদ্যুৎ সংযোগবিহীন অন্ধকার তাই রাতের খাওয়াও সেখানে তাড়াতাড়ি সেরে নিতে হয়। আমরা ক্ষুধার্থ ছিলাম তাই সাদামাটা পাহাড়ি রান্না দিয়ে রাতের খাওয়া সেরে বিছানায়।

অলকানন্দা নদীর কলকল করে ক্রমাগত বয়ে যাওয়ার শব্দ আর মনুষ্যবিহীন প্রত্যন্ত গ্রামে আমরা গুটিকয়েক মনুষ্য ঘন কালো নিকষ অন্ধকারে অপ্রাকৃতিক শব্দকে সঙ্গী করে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না।

ঘুম ভাঙল একদম ভোরবেলায় তখন প্রকৃতি তার কালো অবগুণ্ঠন সরিয়ে দিয়েছেন আর দিনমনির আলোয় ছোট্ট পাহাড়ি তট সোনালী রঙে ঝকমক করছে। পরিবেশ দূষণের কুপ্রভাব না থাকায় আকাশ ঝকঝকে। পাখির ডাক, নদীর কলোচ্ছাশ, সবুজ পাহাড় আর অপরূপ প্রাকৃতিক শোভায় মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না।

গাড়োয়াল মানেই দেবভূমি। দেবভূমি অর্থাৎ দেবতার আবাস স্থল। গাড়োয়ালের পথে পথে দ্রষ্টব্য স্থান প্রচুর। খ্যাত, অখ্যাত দর্শনীয় স্থানের পরতে পরতে জড়িয়ে পুরাণের দেবতাদের গাথা।

বিরোহী  বা বিরেহি-এর সঙ্গেও পৌরাণিক করুণ প্রেম কাহিনী জড়িয়ে রয়েছে। বিরোহী তে রয়েছে বিরেহি নদী আর অলকানন্দা। এই দুই নদীর সঙ্গমস্থলে সতীর দেহবসানের পর বিরহকাতর শিব বিরেহির তটে বসে তপস্যায় বসেন। বিরহী শিবের ঝরে পড়া অশ্রু থেকেই বিরেহি নদীর সৃষ্টি, আর শিবের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে দেবী চন্ডিকা পার্বতী রূপে জন্ম গ্রহণ করেন এবং পুনরায় শিবের ঘরণী রূপে শিবের জীবনে পুনঃপ্রবেশ ঘটে তার।

পৌরাণিক গল্প আমরা শহুরে মানুষ বিশ্বাস করি না। তবু গাড়োয়ালের প্রত্যেকটি স্থানে মনে হয় দেবতাদের স্পর্শ পাওয়া যায়। অদ্ভুত এক নিষ্কলুষ প্রাকৃতিক স্পর্শ যা শরীর মন পবিত্র করে দেয়।

ভোরবেলা উঠে আমরা অল্প ঘোরাঘুরি করে অলকানন্দার জল স্পর্শ করে গায়ে মাথায় বুলিয়ে নিলাম। যদি আর কোনওদিন এখানে না যাওয়া হয় এই ভয় মনে।  প্রিয়পরমকে দেখতে গিয়ে যেমন আমরা আশীর্বাদের ছোঁয়া পেতে চাই তেমনিই অলকানন্দার স্পর্শ নেওয়ার আকুতি আমাদের মনে।

সবুজ পাহাড়ি পাইন ফার বার্চ গাছে ছাওয়া, পাহাড়ের বুক চিরে কালো রাস্তা অজগরের মতো এঁকে বেঁকে চলে গেছে আর বাঁকে বাঁকে হারিয়ে যাওয়ার হাতছানি। কতরকমের নাম না জানা অদ্ভুত দর্শন পাখি, রং বেরঙের ফুলের জলসা আর দূরে পাহাড়ের শৃঙ্গরাজির সমাহার। গাড়োয়ালের পাহাড়ি গ্রাম যেন স্বর্গ। ঘোরাঘুরি, ব্রেকফাস্ট করে একটু বেলা হলে আবার এগিয়ে যাওয়া। গন্তব্য বদ্রি নারায়ণ। মনের গোপন কুঠুরিতে চিরস্থায়ী হলো শিবের তপভূমি বিরোহী।

২০১৩-তে কেদারনাথে মেঘভাঙ্গা বৃষ্টি থেকে যে প্রলয় শুরু হয় তা সম্পূর্ণ গাড়োয়াল কে চরম ক্ষতিগ্রস্ত করে। বিরোহী ও এই প্রলয়ের হাত থেকে রেহাই পায়নি। বিরোহী  অলকানন্দার গায়ে লাগোয়া ছিল। নদীর ধ্বংসলীলায় বিরোহীর অনেক ক্ষতি হয়েছিল শুনেছিলাম। বিরোহী  আর ভৌগোলিক মানচিত্রে অবস্থান করছে নাকি মহাকালের অতল গহ্বরে বিলীন হয়ে গেছে তার খবর পুরোপুরি জানি না। শুধু মনের মণিকোঠায় অক্ষয় অমর হয়ে বেঁচে রয়েছে শিবের বিরহভূমি বিরোহী । অলকানন্দা হয়তো আজও বয়ে চলেছে সেই ব্যথার ক্ষত নিয়ে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...